চিকিৎসকদের শাস্তি দেয়াই কি সমাধান?
১৬ নভেম্বর ২০১৯জোকার নবপল্লির বাসিন্দা চার মাসের কুহেলি চক্রবর্তীর মৃত্যু হয় ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল৷ আড়াই বছর আগের এই ঘটনায় কলকাতার অন্যতম বেসরকারি হাসপাতাল অ্যাপোলোর তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শাস্তি ঘোষণা করেছে ওয়েস্ট বেঙ্গল মেডিকেল কাউন্সিল৷ মৃত শিশু কুহেলি চক্রবর্তীর বাবা-মায়ের অভিযোগ, চিকিৎসার গাফিলতিতে তাদের মেয়ে মারা গিয়েছে৷ অ্যাপোলো হাসপাতালের চার চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ভারতীয় মেডিকেল কাউন্সিলে অভিযোগ জানান তাঁরা৷ সেই অভিযোগের তদন্ত করে পশ্চিমবঙ্গের মেডিরেল কাউন্সিল তিন চিকিৎসককে দোষী সাব্যস্ত করে৷ ডাঃ সুভাষচন্দ্র তিওয়ারি, ডাঃ সঞ্জয় মাহওয়ার ও ডাঃ বৈশালী শ্রীবাস্তবের চিকিৎসার লাইসেন্স তিন মাসের জন্য বাতিল করা হয়৷
কিন্তু এই রায়ে খুশি নন মৃত শিশুর বাবা মা৷ তাঁরা এ জন্য মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন৷ কিন্তু ডাক্তারদের শাস্তি আরও কঠোর হলেই কি এই সমস্যার সমাধান ঘটবে?
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছে, বহু ক্ষেত্রেই রোগীর পরিবারের লোকজন ডাক্তারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করছে৷ ডাক্তার পেটানোর রেওয়াজ তৈরি হয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে৷ চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক কিছুতেই উন্নত হচ্ছে না৷ এর নেপথ্যে অন্যতম কারণ রোগী ও চিকিৎসকের সংখ্যার অনুপাত৷
তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক ও চিকিৎসক সুদীপ্ত রায় বলেন, ‘‘জনসংখ্যার অনুপাতে চিকিৎসক আমাদের দেশে অনেকটাই কম৷ অসংখ্য মানুষ রোজ সরকারি হাসপাতালে ভিড় করে৷ তাদের প্রত্যেকের প্রতি মনোযোগ দেওয়া, সময় নিয়ে চিকিৎসা করা চিকিৎসকদের কাছে চ্যালেঞ্জের৷''
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক রেজাউল করিম একসুরে বলেন, ‘‘ভারত বা বাংলাদেশে একজন চিকিৎসক ৫৯ সেকেন্ডে একজন রোগী দেখেন৷ নইলে তিনি সব রোগী দেখে উঠতে পারবেন না৷ রোগের গুরুত্ব বিচারে ওই সময়টুকু নিশ্চই সব ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়৷''
সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ইএসআই হাসপাতালে প্রথমে ভর্তি করা হয়েছিল কুহেলিকে৷ সেখান থেকে তাঁকে কোলনোস্কোপি করার জন্য অ্যাপোলোয় স্থানান্তরিত করতে হয়৷ অর্থাৎ, ইচ্ছা না থাকলেও মানুষকে যেতে হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে৷
ডাঃ রেজাউল করিমের বক্তব্য, ‘‘আমাদের দেশের অন্যতম বিত্তশালী সংস্থা ইএসআই৷ হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের সম্পদ৷ সেখানে কেন পর্যাপ্ত পরিকাঠামো থাকবে না? কেন একটি শিশুকে এন্ডোস্কোপি করাতে অ্যাপোলোয় নিয়ে যেতে হবে?''
চিকিৎসকদের শাস্তি প্রসঙ্গে ডাঃ সুদীপ্ত রায় বলেন, ‘‘প্রথমে পেনাল কমিটি অভিযোগ খতিয়ে দেখে৷ তারপর কাউন্সিলের মেন কমিটির কাছে বিষয়টি যায়৷ দুপক্ষকেই বিচারের সময় ডাকা হয়৷ অভিভাবকদের মনে হতেই পারে, শাস্তি কম হয়েছে৷ কাউন্সিল যদি কী কারণে তিন মাস শাস্তি দেওয়া হলো তার ব্যাখ্যা দেয় তাহলে আর অস্বচ্ছতা থাকে না৷''
এই সবকিছুর উপরে বারবার আলোচিত হয় রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্কের বিষয়টি৷ সাম্প্রতিক অতীতে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারের ওপর হামলায় এক জুনিয়র ডাক্তার আহত হওয়ায় সম্পর্কের অবনতিই হয়েছে৷ ডাঃ সুদীপ্ত রায়ের মতে, ‘‘আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকলে কিংবা অত্যধিক নিয়মের বেড়াজালে বাঁধলে ডাক্তাররা খোলামনে চিকিৎসা করতে পারবেন না৷ তাতে রোগীর লাভ হবে না৷ উভয়কেই পরস্পরের জায়গাটা বুঝতে হবে৷'' এ জন্য সরকারকে মধ্যস্থতা করার পরামর্শ দিচ্ছেন ডাঃ করিম৷ তাঁর মতে, ‘‘চিকিৎসক ও রোগীর মধ্যে একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছে৷ সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যস্থতা করতে হবে৷ উভয়ের মধ্যে কথা বলার পরিসর করতে হবে৷ পরিকাঠামো উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে এটাও জরুরি৷'' এই চিকিৎসকের ক্ষোভ, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কোনো সুসংহত স্বাস্থ্যনীতি নেই৷ বাম সরকারের আমলেও ছিল না৷ এখনও তৈরি করার উদ্যোগ নেই৷ এ জন্য রোগীরা সমস্যায় পড়ছেন, চিকিৎসকেরাও নিজেদের কাজ ঠিকমতো করতে পারছেন না৷''
দুজনেরই মতে, চিকিৎসকদের শাস্তি দেওয়াটাই সমাধান নয়৷ যথাযথ স্বাস্থ্যনীতি ছাড়া এই সমস্যা মিটবে না৷