জার্মানির ‘নিরাপত্তার রাজনীতি'
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৩নির্বাচনি প্রচারণায় সেনা মোতায়নের প্রশ্ন
যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলে অস্ত্রশস্ত্র ও সেনা পাঠানোর বিষয়টি নির্বাচনি প্রচারণাতেও উঠে আসছে বারবার৷ ‘‘অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধ করো৷ বিদেশে সেনা মোতায়েন বন্ধ করো৷'' বাম দল বা ‘ডি লিংকে'-র নির্বাচনি প্রচারণার প্ল্যাকার্ডে দেখা যায় এই ধরনে স্লোগান৷ জার্মান সংসদের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ডি লিংকেই একমাত্র পার্টি, যেটি আফগানিস্তানসহ সব দেশ থেকেই জার্মান সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে৷ আর বিষয়টি নিয়ে জোরেসোরেই নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছে তারা৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সক্ষাৎকারে বামদলের সাংসদ ইয়ান ফান আকেন বলেন, ‘‘বামদের হৃদয়ের বিষয় এটি৷''
আফগান মিশনের মূল্যায়ন
এখন পর্যন্ত আফগানিস্তানের উত্তরে জার্মান সেনাবাহিনী ‘বুন্ডেসভেয়ার'-এর ৪১০০ সেনা মোতায়েন রয়েছেন৷ ডি লিংকে ছাড়া অন্যান্য দলগুলি মনে করে না যে এই মিশন ব্যর্থ হয়েছে৷ এই প্রসঙ্গে তারা দেশটির পুনর্গঠনে সাফল্যের কথা তুলে ধরে৷ এছাড়া ২০১৪ সাল থেকে আফগানরা যে নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি হাতে নিতে পারবে বলে অঙ্গীকার করেছে, সেটাও উল্লেখ করে অন্য দলগুলি৷ তবে সরকার ও সংসদ যে আফগানিস্তানের সেনামিশনকে ছোট করে দেখেছে এই ব্যাপারে প্রায় সব দলই কমবেশি একমত৷
২০০২ সালে মিশনের শুরুতে জার্মানি কয়েকশ সেনা পাঠিয়েছিল আফগানিস্তানে৷ সীমিত সময়ের জন্য রাজধানী কাবুলের নিরাপত্তার দিকে লক্ষ্য রাখাই ছিল তাঁদের দায়িত্ব৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাবাহিনীর এই হিসাবটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়৷ তালিবান জঙ্গিরা তাদের সহিংসতা চালিয়ে যেতে থাকে৷ তাদের দমন করা আফগানিস্তানের নবগঠিত সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ আফগান আর্মি ও পুলিশবাহিনীর অবস্থাও ছিল বড় করুণ৷
উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিসটেন্টস ফোর্স' বা ইসাফ দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্বভার গ্রহণ করে৷
প্রায় ৫০টি দেশের সেনাসদস্যরা সম্পৃক্ত হন এই বাহিনীতে৷ প্রথম দিকের ৫০০০ থেকে ২০১০ সালে সেনা সংখ্যা ১৩০,০০০-এ দাঁড়ায়৷ কিছু অঘটন এই বুন্ডেসভেয়ারের এই মিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে৷ আলোড়ন তোলে জার্মানির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জগতেও৷ ২০০৯ সালে জার্মান এক অফিসারের আদেশে বিমান আক্রমণ করা হয় আফগানিস্তানের কুন্ডুস-এ৷ বেশ কিছু বেসামরিক ব্যক্তি মারা যায় এই হামলায়৷ ফলে সেসময়ের জার্মান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্রান্স ইওসেফ ইয়ুং পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷
বহু জার্মান সেনা হতাহত হয়েছেন
আফগানিস্তানের এই মিশনে এই পর্যন্ত অর্ধশতাধিক জার্মান সেনা মারা গেছেন৷ এক্ষেত্রে অনেক উচ্চ মূল্যই দিতে হয়েছে জার্মান সেনাবাহিনীকে৷ ইতোমধ্যে অবশ্য আফগানিস্তান থেকে জার্মান সেনা প্রত্যাহারের কাজ শুরু হয়েছে৷ ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ এই প্রক্রিয়া শেষ হবে৷ ভবিষ্যতে এই ধরনের কোনো মিশন হলে প্রথম থেকেই সেনা প্রত্যাহারের কলাকৌশল মাথায় রাখতে হবে, জানায় সিডিইউ সরকারের কোয়ালিশন সহযোগী এফডিপি৷ আর সবুজ দলের দাবি সেনা প্রত্যাহার করা হলে বুন্ডেসভেয়ারে কর্মরত আফগান কর্মীদের জার্মানিতে আশ্রয় দিতে হবে৷ স্থানীয় কর্মীদের জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়ায় বোঝা যায় আফগানিস্তানের পরিস্থিতি কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে৷
কয়েক বছর ধরে বুন্ডেসভেয়ারকে বিভিন্ন মিশনে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে৷ কিন্তু বিষয়টির সামগ্রিক মূল্যায়ন এখন পর্যন্ত করা হয়নি৷ ‘আফগানিস্তান শকে'-র পর বিদেশে সেনামিশন পাঠানোর ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলির মতামত অনেকটা অস্পষ্ট৷
সামাজিক গণতন্ত্রী দলের হানস পেটার বার্টেলস-এর মতে, ‘‘একটি সঠিক মিশনের কাজ হলো সব কিছুতেই নাক না গলানো৷ সংকট সমাধানে স্থানীয় শক্তিগুলিকেও সম্পৃক্ত করা৷ যেমনটি করে থাকে ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন'-এর মতো সংস্থাগুলি আঞ্চলিক কোনো সমস্যা দেখা দিলে৷ আমরা শুধু সহায়তা দিতে পারি৷''
বামদল যুদ্ধবিরোধী
পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে জার্মান বাণিজ্য জাহাজে জলদস্যুদের আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বুন্ডেসভেয়ারকে সচল করার ওপর জোর দেয় খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক ইউনিয়ন বা সিডিইউ৷ তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় পরোক্ষে হলেও বলা হচ্ছে, বুন্ডেসভেয়ার-মিশনের সাথে জার্মানির অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা উচিত৷ এসপিডি ও সবুজ দল বেসামরিক পর্যায়ে সংকট প্রতিরোধ ও মোকাবেলার ওপর বিশেষ জোর দেয়৷ বামদল আরো এক ধাপ এগিয়ে৷ তাদের দাবি, বিদেশে জার্মান সেনাবাহিনীর মিশন সমাপ্ত হলে যে অর্থের সাশ্রয় হবে, তা শান্তিরক্ষা-বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণের কাজে ব্যয় করতে হবে৷
বামদলরা এমন কোনো সরকারে অংশগ্রহণ করতে চায় না, যেটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বিদেশে সেনাবাহিনী পাঠায়৷ আর এ কারণে গাণিতিক দিক দিয়ে এসপিডি, সবুজদল ও বামদল মিলে সংসদীয় নির্বাচনে যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়ও, জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করার সম্ভাবনা তাদের প্রায় নেই বললেই চলে৷