ঢাকার সমস্যা ঢাকার বাইরে
১৯ মার্চ ২০১৮ঢাকা শহরে আমার প্রথম আসা ১৯৯৯ সালে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষ্যে৷ তখন ঢাকার সব রাস্তায় রিকশা চলতো৷ যানজট তেমন একটা ছিল না বললেই চলে৷ কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে পুরোপুরি বদলে গেলো দৃশ্যপট৷ চিপা-গলি থেকে শুরু করে বড় রাস্তা সব জায়গায় যানজট শুরু হয়েছে৷ ১৯৮০ সালে যেখানে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখ, সেখানে আজ এই শহরে প্রায় ২ কোটি মানুষের বাস৷ কিন্তু নগর নিয়ে নেই কোনো যথার্থ পরিকল্পনা৷ নগর পরিকল্পনায় ব্যর্থতা সব ক্ষেত্রেই ডেকে আনছে বিপর্যয়৷
ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থাটা বুঝতে হলে একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে৷ লোকালয় হিসেবে ঢাকা বেশ প্রাচীন৷ মোগল আমল পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা গড়ে উঠেছিল৷ ১৬০৮ সালে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা পায়৷ ব্রিটিশ আমলে বর্তমান ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ঢাকা মিউনিসিপালিটি হিসেবে যাত্রা শুরু করে ১৮৬৪ সালে৷ ১৯১৭ সালে ঢাকার জন্য আধুনিক নগর পরিকল্পনা বিষয়ক প্রথম রিপোর্ট প্রণীত করেন বিখ্যাত স্কটিশ পরিকল্পনাবিদ স্যার প্যাট্রিক গেডেস৷ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি৷ এারপর ১৯৫৯ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার জন্য ডিআইটির তত্ত্বাবধানে প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়৷ তখন ঢাকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩ লাখ৷ এরপর জনসংখ্যা বাড়তে থাকলেও পরিকল্পনায় কোন পরিবর্তন আসেনি৷
১৯৯৭ সালে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজউকের তত্ত্বাবধানে সরকার ঢাকা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান বা ডিএমডিপি অনুমোদন করে৷ কিন্তু তার বাস্তবায়ন কতটা হয়েছে তা আপনারাই বলতে পারবেন৷
বিকেন্দ্রীকরণ কেন প্রয়োজন?
মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে ঢাকার জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে৷ প্রশাসনের কারণে আমাদের অর্থনীতি, বাণিজ্য ঢাকা কেন্দ্রিক৷ গ্রাম থেকে নদী ভাঙা মানুষ কাজ করতে আসে ঢাকায়৷ উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা ছুটছে ঢাকার দিকে, কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও, অনেক বড় বড় সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদালয়গুলো এখানে৷ বড় বড় হাসপাতাল-তাও ঢাকাতেই৷ নীতি-নির্ধারকদের দূরদর্শিতার অভাবে সবকিছুই গড়ে উঠেছে ঢাকাকে কেন্দ্র করে৷ এর ফলে ঢাকামুখী জনসংখ্যার চাপ কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না৷
বাংলাদেশে যেটুকু শিল্পায়ন হয়েছে, যতটুকু বিনিয়োগ হয়েছে বা হচ্ছে, তার প্রায় পুরোটাই ঢাকা, চট্টগ্রাম বা ঢাকার আশেপাশের এলাকাকে কেন্দ্র করে৷ পোশাক শিল্প-কারখানার কথাই ভাবুন৷ শুধু এই একটি সেক্টরে কাজ করতে এসে কত মানুষ ঢাকায় থাকছে, আর এদের থাকার কারণে কত বস্তি গজিয়ে উঠেছে৷
মফঃস্বল শহরের উন্নয়ন করতে না পারলে ঢাকা মহানগরের সমস্যার সমাধান করা যাবে না৷ প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলার ডিসি, এসপি, তাঁদের পরিবার কোথায় থাকে? ঢাকাতেই থাকে৷ ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পরিবারও ঢাকায় থাকা শুরু করেছে৷ এটা আরও হবে; কারণ, মফঃস্বলে তাদের প্রয়োজনীয় সেবাগুলো নেই৷ এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ঢাকার সমাধান কখনোই হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মফঃস্বল শহরে প্রয়োজনীয় সেবা তৈরি না হবে৷
তাই কর্মসংস্থানের সুযোগ শুধু ঢাকা বা আশেপাশের এলাকায় তৈরি করে দিলে হবে না৷ টেকসই প্রবৃদ্ধির স্বার্থেই বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে৷ বিনিয়োগ বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারলে ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমে আসবে৷ দেশের অনুন্নত অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ উৎপাদনের জরুরি উপকরণের সহজলভ্যতা কীভাবে সৃষ্টি করা যায়, সে বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷
ভূতের গলি বা মীরবাগ – এ সব এলাকায় যদি কোনো মানুষ অসুস্থ হয় তাহলে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়ির গলি পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব নয়৷ গায়ে গায়ে বাড়ি উঠেছে৷ এর ফলে অসুস্থ মানুষটি হয়ত হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারেন না৷ এমন ঘটনা ঘটছেও অহরহ৷ রাস্তার দু’দিকে যেভাবে অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, সেগুলো ভেঙে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রশস্ত করার সম্ভাবনা ক্ষীণ৷ রাজউককে কোনো অবকাঠামোর অনুমোদন দেয়ার আগে রাস্তা সম্পর্কে আরও শক্ত অবস্থান দেখাতে হবে৷ শিল্প-কারখানা সাধ্যমতো রাজধানীর বাইরে স্থানান্তর করা গেলে উৎপাদনের খরচ যেমন কমে আসবে, তেমনি স্থানীয় শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে৷ ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠবে৷
নগর পরিকল্পনার ভাষায়, একটি দেশে এককভাবে নানাবিধ কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে ওঠা একটি শহর, যার উপর পুরো দেশ নির্ভরশীল তাদেরকে বলা হয় প্রাইমেট সিটি৷ তাই ঢাকা উপর থেকে নির্ভরশীলতা অন্যান্য শহরে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যেমনটা করেছে৷ রাজধানীর উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য পুত্রজায়ায় প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থানান্তর করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র পরিবর্তনের কথা শোনা গেলেও তা কার্যকরের কোনো নমুনা দেখা যায়নি৷ এমনকি ঢাকা শহরের ভেতর ক্যান্টনমেন্টও একটা বাড়তি বোঝার মতো৷ শহরের মধ্যেখানে বিশাল অংশ জুড়ে অবস্থিত এই এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ৷ তাই খুব অল্প দূরত্ব পথও মানুষকে ঘুরে যেতে হয় এলাকাটির কারণে৷ অন্যান্য সড়কগুলোর উপর চাপ পড়ে৷ বাড়ে মানুষের ভোগান্তি৷
বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা
ইউরোপের যে জিনিসটা আমার নজর কাড়ে তাহলো সড়কের চেয়ে রেল পথের ব্যবহার৷ অর্থাৎ যাদের গাড়ি আছে তারাও অফিস টাইমে ট্রাম বা মেট্রোতেই যাতায়াত করেন বেশি৷ ঢাকা শহরে এ ধরনের বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা চালু করা হলে সড়কের উপর চাপ কমবে৷ মানুষ যদি গাড়ি কম ব্যবহার করে, তাহলে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হবে না৷
বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ৷ এর প্রায় ২ কোটি প্রতিবন্ধী৷ তারা বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা ট্যাক্স দেয়৷ তাদের জন্য আমাদের সুযোগ-সুবিধা নেই৷ ফুটপাত কীভাবে সুন্দর হবে? পথের মাঝেমধ্যে লাইটপোস্ট, টেলিফোনপোস্ট ইত্যাদি রয়েছে৷ একেকটা একেক সংস্থার অধীনে৷ তাই আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে যায় পরিকল্পনা৷
ঢাকাসহ দেশের সব শহর নিয়ে একটি মহাপরিকল্পনা করা জরুরি৷ সেজন্যই সবচেয়ে বেশি জরুরি বিকেন্দ্রীকরণ৷ অর্থাৎ আমার মতো যারা মফঃস্বলে বড় হয়েছে তাদের পড়ালেখা, তাদের চাকরি, চিকিৎসা সেবাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা যাতে প্রতিটা শহরেই থাকে সে ব্যবস্থা করা গেলেই ঢাকা শহর এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পাবে৷ মফঃস্বল শহরের উন্নয়ন ছাড়া কোনো দিন মহানগরের সমস্যার সমাধান হবে না৷
কেমন লাগলো ব্লগটি লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷