মোদী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের বিশেষ স্থান
১৫ মার্চ ২০১৫প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সফল জমি তৈরি করতে প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়৷ ভারত-বাংলাদেশের বহুমাত্রিক সম্পর্কের যে দু'টি প্রধান সমস্যার জট এখনো খোলা যায়নি, তার আশু সমাধানে মোদী সরকার তার রাজনৈতিক সদিচ্ছায় কোনো খামতি রাখবে না, সেই বার্তা দিতেই সুষমা স্বরাজ ঢাকা যান৷
এখানেই শেষ নয়৷ বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়াতে মোদী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে যে নতুন হাওয়া বইছে, তাতে ভর করে পররাষ্ট্রসচিব পদে নিয়োগের এক মাসের মধ্যেই নতুন পররাষ্ট্রসচিব এস. জয়শঙ্কর ঢাকা নেতৃত্বকে বার্তা দিয়ে এসেছেন যে, ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্বে রয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সবুজ সংকেতও নাকি পাওয়া গেছে৷ বর্তমানে স্থলসীমা চুক্তিটি সংসদের অনুমোদনের অপেক্ষায়৷ খুব সম্ভবত সংসদের চলতি অধিবেশনেই তা অনুমোদিত হবে, সরকারি মহল থেকে বলা হচ্ছে এমনটাই৷
যেহেতু স্থলসীমা চুক্তিতে ভারতীয় ভূখণ্ড হস্তান্তরের প্রশ্ন জড়িত, তাই সংবিধান অনুসারে সংসদের অনুমোদন দরকার৷ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার এই চুক্তিতে বেঁকে বসায় তা ঝুলে ছিল এতদিন৷ সংসদের নিম্নসভা লোকসভায় মোদী সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও, উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় শাসক দল বিজেপির সেটা নেই৷ তবে এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থন পাওয়ার পর এই সংক্রান্ত বিল পাশ এখন শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা৷
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অতি সম্প্রতি ঢাকায় গিয়ে সে কথা বলেও এসেছেন৷ তিস্তা চুক্তি ইস্যুতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগেকার অনড় অবস্থান অনেকটাই নরম হয়েছে৷ কিছু বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের আশা প্রকাশ করেছেন তিনি৷ অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর মূল আপত্তি থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন৷ তাই কেন্দ্র-রাজ্য আলোচনা প্রক্রিয়া এবার নতুন মোড় নেবে বলে মনে করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তা-ব্যক্তিরা৷
বাংলাদেশ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে মমতা যা বলে এসেছেন, ঢাকা থেকে ফিরে এসেই মোদীকে লেখা চিঠিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সে'কথা জানিয়েছেন৷ এরপর গত ৯ই মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে তিনি তিস্তা চুক্তি ইস্যুতে তাঁর দলের এবং সরকারের ইতিবাচক নীতির কথা জানিয়ে বলেছেন, তিস্তা জলবণ্টন চুক্তির জট কাটাতে তাঁর দল সহযোগিতা করবে৷ মমতা বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রি বাড়ানোর পথে তিনি কাঁটা হতে চান না৷ চান ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক৷
উল্লেখ্য, দু'দেশের মধ্যে ৫৪টি নদ-নদী আছে যা এক দেশে থেকে বয়ে গেছে অপর দেশে৷ ঢাকায় তিনি বলে এসেছেন, ‘‘পদ্মা, মেঘনা, গঙ্গা, যমুনার মধ্যে কোনো ভেদ নেই৷ আস্থা রাখুন৷ তিস্তা নদীর জলবণ্টনের সন্তোষজনক সমাধান হয়ে যাবে৷'' অথচ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনি ময়দান মমতা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, তিস্তার জল বাংলাদেশকে দিয়ে দিলে উত্তরবঙ্গে জলসংকট দেখা দিতে পারে৷ শুধু তাই নয়, এ নিয়ে গণ আন্দোলনের জিগিরও তুলেছিলেন তিনি৷
২০১১ সালে পূর্বতন কংগ্রেস-জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ঢাকা সফরে গিয়ে ঐ চুক্তি করে আসা সত্ত্বেও তৃণমূল সরকারের জোরালো আপত্তিতে তা দিনের আলো দেখেনি৷ মোদী সরকার সেই ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তিকে বাস্তবায়িত করে দেখাতে চাইছেন যে, সাবেক কংগ্রেস সরকার যা পারেননি, বিজেপি সরকার তা পেরেছেন৷ এর জন্য ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনারের কার্যকালের মেয়াদ ফুরিয়ে আসা সত্ত্বেও তাঁর কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যাতে তিনি দু'দেশের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারি হতে পারেন৷ মোদী বোঝাতে চান, দিল্লির পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব আলাদা৷ এক কথায় বাংলাদেশের সব ক্ষোভ ও অসন্তোষের অবসান ঘটিয়ে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক তথা ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে ভারত-বাংলাদেশকে পরস্পরের আরও কাছে আনতে উদ্যোগী মোদী সরকার৷
প্রশ্ন হচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হঠাৎ ভোলবদলের কারণ কী? কিছুদিন আগে পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোদীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়টুকু পর্যন্ত করেননি৷ সযত্নে এড়িয়ে গেছেন দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ৷ মোদীর ডাকা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অন্যসব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা যোগ দিলেও, যোগ দেননি তিনি৷ কূটনৈতিক মহলের একাংশ মনে করছেন, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের মুখে সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি আর পশ্চিমবঙ্গে জামাত জঙ্গিদের কার্যকলাপ যেভাবে প্রকাশ্যে এসেছে, তাতে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের গলায় পড়েছে ফাঁস৷ আর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে সেই ফাঁস ক্রমশই শক্ত হচ্ছে৷ সেক্ষেত্রে কেন্দ্রের সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক নিয়ে চললে আখেরে তাঁর সরকার এবং দলেরই লোকসান৷
অপরদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা প্রসারিত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত না ধরলে তা পদে পদে ঠোক্কর খাবে, সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছে মোদী সরকারও৷ এপার বাংলা-ওপার বাংলার অভিন্ন সীমান্তে ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থলপথ, জলপথে যোগাযোগে ছাড়াও বাংলাদেশের মাটিতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি তৎপরতা দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের৷ ভারতের ‘লুক ইস্ট' বা পুবে তাকাও এবং চীন-বাংলাদেশ-মিয়ানমার আঞ্চলিক নীতির প্রেক্ষাপটে মোদী সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অভিমুখ হবে বাংলাদেশ, কূটনৈতিক মহলের এমনটাই অভিমত৷ এক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার কেউই সংঘাতের পথে যেতে চাইবে না মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের কথা মাথায় রেখেই৷