‘নোটবন্দির' পর ভারতে ‘নোটমন্দা'
২০ এপ্রিল ২০১৮বিগত কয়েকদিন ধরে অর্ধেক ভারতজুড়ে শুরু হয়েছে নোটমন্দা, যা স্মরণ করাচ্ছে নোটবন্দির দুর্দশা৷ সাধারণ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে শুধুই আশ্বাস৷ দেশবাসীকে ধৈর্য ধরতে বলছেন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ও তাঁর মন্ত্রকের আমলারা৷ কিন্তু নোটের আকালে ঘরপোড়া গরুর মতো সিঁদুরে মেঘ দেখছে আম জনতা৷ কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ, বিহার, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগঢ় ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের অন্তত ১০ রাজ্যের বেশিরভাগ এটিএম কার্যত ‘নো-ক্যাশ' হয়ে রয়েছে৷ ওদিকে প্রধানমন্ত্রী মোদী রয়েছেন বিদেশ সফরে৷
অভিযোগ উঠছে, আগামী বছর দেশে লোকসভা নির্বাচন৷ তাই নির্বাচনে টাকা ছড়ানোর জন্যই এখন থেকে ২০০০ টাকার নোট তুলে জমিয়ে রাখতে শুরু করেছে কয়েকটি রাজনৈতিক দল৷ কর্ণাটকে আগামী মাসেই ভোট৷ লক্ষণীয়, বাজার থেকে উধাও হয়েছে সবচেয়ে বড় অঙ্কের ২০০০ টাকার নোটই৷ বিপুল অঙ্কের টাকা মজুত করতে হলে বড় অঙ্কের নোটই তো ভরসা! বলা বাহুল্য, এদেশে নির্বাচনি প্রচারে নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত সীমারেখার থেকে কয়েক'শ গুণ বেশি অর্থ খরচ করার নজির যত্রতত্র৷
এরই মধ্যে দুঃখজনক একটি ঘটনা সামনে এসেছে৷ চিকিৎসার জন্য এক অসুস্থ বৃদ্ধা ব্যাংকে নিজের জমানো টাকা তুলতে গিয়েছিলেন৷ নির্দিষ্ট ‘টাকা তোলার ফর্ম' পূরণ করে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকের লাইনে দাঁড়াচ্ছিলেন নূরজাঁহা বিবি৷ কিন্তু গত চার দিনেও টাকা দিতে পারেনি ব্যাংক৷ শেষ পর্যনত নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন নূরজাঁহা৷ তাঁর ছেলে লাল মহম্মদ ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন৷ বলছেন, ‘‘মায়ের চিকিৎসার জন্য ১৭ হাজার টাকার প্রয়োজন ছিল৷ চার দিন পর গতকাল ব্যাংকের কোষাধ্যক্ষ মাত্র ৫ হাজার টাকি দিতে রাজি হন৷''
এদিকে, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের (আরবিআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে পরবর্তী দু'বছরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলি দেশে ৪৫ হাজারের বেশি এটিএম চালু করে৷ ২০১৭ সালের মার্চ থেকে দেশে প্রতিমাসে গড়ে পাঁচটি করে এটিএম বন্ধ হয়েছে৷ ২০১৬-১৭ সালে, নোটবাতিলের পর মাত্র তিন হাজার এটিএম চালু করা গেছে৷ ‘নন পারফর্মিং অ্যাসেট', অনাদায়ী ঋণ, তছরুপ প্রভৃতির কারণে বহু ব্যাংকই নাকি তাদের এটিএমের সংখ্যা বাড়াতে পারেনি৷
নতুন দিল্লির হুমায়ুন রোডের বাসিন্দা ড. অতসী চ্যাটার্জির রয়েছেন দুশ্চিন্তায়৷ তাঁর মতে, দেশের সাধারণ নাগরিককে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়ে গোটা দেশে অর্থনৈতিক অরাজকতা তৈরি করা হচ্ছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘আমি নিজে এটিএম কম ব্যবহার করি৷ কিন্তু আশেপাশের সবাইকে দেখছি এটিএম-এ গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসছেন৷ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার টাকা নেই৷ অথচ ব্যাংকে সঞ্চিত আছে টাকা৷ এ সব দেখে মনে হচ্ছে, ‘বেঁচে আছি তো!' মানুষ মরে যাচ্ছে৷ কিন্তু সরকার উদাসিন৷ প্রধানমন্ত্রী সাধারণ মানুষের কথা ভাববেন না? গরিব মানুষের কথা শুনবেন না? গোটা দেশে যেন অর্থনৈতিক অরাজকতা শুরু হয়েছে৷ আগামীদিনে আমরা কীসের ওপর ভরসা করব, জানি না৷ আমাদের অনুরোধ, এই সমস্যা নিয়ে সরকার ভাবুক৷ সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনযাপনে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে ন্যূনতম এইটুকু সহযোগিতা না পেলে জীবন যে অতিষ্ট হয়ে ওঠে৷''
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একদিকে যখন এমন সংবাদ আসছে তখন নতুন দিল্লিতে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যাল জানাচ্ছেন, ‘‘কেন এটা ঘটল আমরা জানি৷'' কিন্তু তা খোলসা করতে রাজি নন তিনি! তবে তিন-চার মাস আগে সরকার যে খরচ বাঁচাতে ২০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করতে বলে রিজার্ভ ব্যাংককে, সেটা তিনি স্বীকার করেন৷ দেখা যাচ্ছে, তার পরই নগদ টাকা তোলার হার বেড়ে গেছে৷ ২০০০ টাকার নোট ছাপা বন্ধ করে ২০০ টাকার নোট ছাপছিল রিজার্ভ ব্যাংক৷ কিন্তু বহু জায়গাতেই এটিএম-এর মাপ সেইমতো বদলানো হয়নি৷ ২০০ টাকার নোট পৌঁছেছে কম৷ ২০০০ টাকার অভাব এতে কিছুই মেটেনি৷
কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের সচিব সুভাসচন্দ্র গর্গ বলছেন, ‘‘এই সমস্যার সমাধানে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২৫০০ কোটি ৫০০ টাকার নোট ছাপা হবে৷'' সরকারি সূত্র বলছে, নোট বাতিলের পর গত দেড় বছরেও নতুন নোট সরবরাহ করার মতো এটিএমগুলির পরিকাঠামো তৈরি করা হয়নি৷ তবে নোট বাতিলের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বাজারে যেখানে ১৭ দশমিক ৬ লক্ষ কোটি নগদের জোগান ছিল, এখন তা ১৮ দশমিক ৪ লক্ষ কোটি৷ তা সত্ত্বেও এই নগদ-যন্ত্রণা কেন? জোগানের ঘাটতি নাকি অপ্রত্যাশিত নগদ মজুত করা? অর্থনীতি বিশারদরা অবশ্য এর পেছনে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন৷ গত কয়েকদিনে শুধুমাত্র বিহারে ৮০০ থেকে ৯০০ কোটি টাকা তোলা হয়েছে এটিএম মারফৎ৷ এতকিছুর মাঝে মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের অভিযোগ, ‘দু-হাজারি নোটের ঘাটতি আসলে ষড়যন্ত্র৷' তাঁর অভিযোগের আঙুল বিরোধী কংগ্রেসের দিকে৷
নতুন দিল্লির বাঙালি প্রধান অঞ্চল চিত্তরঞ্জন পার্ক৷ দীর্ঘদিন ধরে সমাজসেবার সঙ্গে যুক্ত উৎপল ঘোষ একটি বাংলামাধ্যম বিদ্যালয়ও চালান৷ নগত সমস্যায় ভুক্তভোগী হয়ে বেজায় ক্ষুব্ধ তিনি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানান, ‘‘নোটবন্দি থেকে নোটমন্দায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট ও ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে প্রকৃত স্বচ্ছতা বজায় রাখা সাধারণ মানুষ৷ স্বাধীনতার পর থেকে আজও পর্যন্ত কখনও সংবাদপ্তের হেডলাইন চোখে পড়েনি যে রিজার্ভ ব্যাংক কী ধরনের কতগুলো নোট ছাপছে৷''
সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলেছেন উৎপল৷ তাঁর অভিযোগ, ‘‘সরকারের কথা ও কাজের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই৷ গরিব মানুষকে এটিএম-এ গিয়ে ঘুরে আসতে হচ্ছে৷ দৈনন্দিন জীবনে যাদের নগদ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই খেটেখাওযা মানুষ পথে বসেছেন৷ বাস্তবে আমি নিজে এটিএম-এ গিয়ে টাকা না পেয়ে ফিরে এসেছি৷ এর দায় কে নেবে? দায় নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে৷ তা তিনি যেখানেই থাকুন না কেন৷ তাছাড়া বিদেশি পর্যটকদের অসুবিধার কথাও অস্বীকার করতে পারবে না সরকার৷ সেক্ষেত্রে গোটা বিশ্বে মুখ পুড়ছে ভারতের৷''
অন্যদিকে, নোট বাতিলের মতোই আরও একবার অর্থমন্ত্রক ও রিজার্ভ ব্যাংকের কর্তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়েছে৷ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পেশ করেছে উভয়েই৷ গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় নোটমন্দা নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার পর তাড়াহুড়ো করে অর্থমন্ত্রক, রিজার্ভ ব্যাংক, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক উপদেষ্টা-সহ বিভিন্ন স্তর থেকে সাফাই দেওয়া শুরু হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে প্রথমে অর্থমন্ত্রক সাফাই দিয়ে জানায়, ‘নোটের কোনো অভাব নেই৷' এর কিছুক্ষণ পরেই রিজার্ভ ব্যাংক প্রেস রিলিজ দিয়ে জানায়, দেশে প্রায় পাঁচটি রাজ্যে ১২-১৩ দিন ধরে অপ্রত্যাশিতভাবে নোট সংগ্রহ করেছেন গ্রাহকরা৷ এ জন্যই নোটের আকাল দেখা দিয়েছে৷ আরবিআই একটি আন্তঃরাজ্য কমিটি গঠন করেছে যা নোট-সংকটে থাকা রাজ্যগুলিতে বেশি পরিমাণ নগদ পাঠানোর কাজে নজরদারি রাখবে৷ ঘটনা হলো, বারবার দাবি করা হয়েছে, সরকারের কোষাগারে যথেষ্ট নোট রয়েছে৷ কিন্তু তারপরেও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়, সরকার আরবিআই-কে যত শিগগির সম্ভব ৫০০ টাকার নোট ছাপার নির্দেশ দিয়েছে৷ প্রশ্ন উঠছে, নোট যদি থাকেই তবে নতুন নোট ছাপার নির্দেশ কেন?
সমাজবাদী পার্টি প্রধান তথা উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব আবার এর পেছনে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র দেখছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘নোট ছাপার মেশিন, কাগজ, কালি-সহ যাবতীয় সরঞ্জাম বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়৷ নিশ্চয় সেখানেই ষড়যন্ত্রের শিকড় লুকিয়ে আছে৷'' তবে কারণ যা-ই হোক, গত কয়েকদিন ধরে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্যে নগদের যে হাহাকার চলছে, তা অগ্রাহ্য করা যায় না কিছুতেই৷
আপনার কী মনে হয়? ভারতে নোটমন্দার কারম কী? লিখুন নীচের ঘরে৷