নোট বাতিল করা কি ঠিক ছিল?
১ সেপ্টেম্বর ২০১৭শেষ পর্যন্ত তথ্যটা বেরিয়ে এলো৷ রিজার্ভ ব্যাংকের ২৪৪ পৃষ্ঠার বার্ষিক রিপোর্টে কোণঠাসা হলো ভারত সরকার৷ নোট বাতিল করে আদৌ কোনো লাভ হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে ঐ রিপোর্ট৷ বলা হয়েছে, ১৫ দশমিক ৪৪ লক্ষ কোটি টাকার বাতিল নোটের মধ্যে মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকার হদিশ নেই৷ বাকি সব টাকা ফিরে গেছে সরকারের হাতে৷ অর্থাৎ কালোটাকা, সাদাটাকা প্রায় সবই জমা পড়েছে! পুরোনো নোট বাতিলের সময় বাজারে ছিল ১৫ দশমিক ৪৪ লক্ষ কোটি টাকা৷ এর মধ্যে ফিরে এসেছে ১৫ দশমিক ২৮ লক্ষ কোটি৷ অর্থাৎ, বাতিল করে দেওয়া টাকার ৯৯ শতাংশই ফিরে এসেছে ব্যাংকে! বাইরে পড়ে আছে মাত্র ১ শতাংশ! বলাই বাহুল্য, বিরোধীদের হাতে আরেকটি মহাস্ত্র উঠে এলো৷ এরপরেও অবশ্য ভুল স্বীকার করতে নারাজ সরকার৷
গতবছর নভেম্বরে দেশ জুড়ে তোলপাড় তুলে ১০০০ ও ৫০০ টাকার নোট বাতিল করেছিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার৷ যার জেরে বিস্তর হেনস্থা হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে৷ নিজের টাকা তোলার জন্য ব্যাংক ও এটিএম-এর লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১০৪ ছাড়িয়েছে৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, কালো টাকা ধরার অভিযান সঠিক৷ দুশ্চিন্তা নাকি শুধু কালোটাকার কারবারিদের৷ যত দিন গেছে, তত সংশয় বেড়েছে, কাজের কাজ হয়নি৷ অবশেষে বার্ষিক রিপোর্টে তথ্য প্রকাশ করেছে আরবিআই৷
প্রশ্ন উঠছে, তা হলে দেশবাসীকে, দেশের অর্থনীতিকে এতটা যন্ত্রণা কেন দিলেন মোদী? প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা চিদম্বরমের প্রশ্ন, ‘‘নোট বাতিল কি তবে কালো টাকাকে সাদা করারই উপায় ছিল?'' বিরোধীদের তৎপরতা দেখে যুক্তি সাজাচ্ছে সরকারও৷ অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি দাবি করছেন, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা এনেছে৷ বলছেন, ‘‘নোট বাতিলের সব লক্ষ্যই পূরণ হয়েছে৷ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো শিকড়-সহ কালো টাকা উপড়ে বের করে আনা৷''
তাঁর যুক্তি, ব্যাংকে টাকা জমা পড়া মানেই সব সাদা হয়ে যাওয়া নয়৷ সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরি হয়েছে৷ বিপুল টাকার মালিকদের ওপর নজর রেখে চলেছে আয়কর দপ্তর৷ বিষয়টিকে প্রচারে আনতে এবং নোট বাতিলের ভালো দিকগুলি তুলে ধরতে খুব শিগগিরই সাংবাদিক সম্মেলন ডাকতে চলেছেন তিনি৷
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার বলছেন, ‘‘পেনাল্টি স্কিম নোট বাতিলের আগে হয়েছিল৷ সেখানে ৬৫ হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছিল৷ তার মধ্যে ২৯ হাজার কোটি কর পাওয়া গিয়েছিল৷ কিন্তু এক্ষেত্রে কর হিসেবে কত টাকা বাড়তি পাওয়া গেল তার হিসেব পাওয়া যায়নি৷''
আয়কর বিভাগ জানিয়েছে, নোট বাতিলের পর জমা পড়া ২ লক্ষ ৮৯ হাজার কোটি টাকা এখন তাঁদের নজরে রয়েছে৷ ৯ লক্ষ ৭২ হাজার মানুষ মোট ১৩ লক্ষ ৩৩ হাজার অ্যাকাউন্টে ঐ টাকা জমা করেছেন৷ কিন্তু এই আমানতগুলো খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে কতদিন সময় লাগবে তা জানানো হয়নি৷ বলা হয়েছে, আয়কর দেন না, এমন ব্যক্তিদের ১ কোটি টাকার বেশি দামের ১৪ হাজার সম্পত্তিও এখন তাঁদের নজরে রয়েছে৷ অর্থাৎ ব্যাংকে টাকা জমা করে দিয়ে কালো টাকার মালিকেরা নিষ্কৃতি পেয়ে গেছেন, এমন নয়৷
নোট বাতিলের সময় বলা হয়েছিল, বাজারে যে টাকা ছিল, তার প্রায় ২০ শতাংশই কালো টাকা৷
অর্থনীতিবিদ সুমন মুখোপাধ্যায় অবশ্য নোট বাতিল সিদ্ধান্তের পক্ষে সওয়াল করছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘কেন এই নোট বাতিল, তা ক'জন জানেন! কালো টাকা নোটে থাকে না৷ কালো টাকা থাকে সোনা, স্থাবর সম্পত্তি এবং স্টক মার্কেটে৷ নোট বাতিলের পর এ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে৷ এ দেশে কালো টাকার হদিশ কবে ছিল? মাত্র তিন বছরে হদিশ কেন আসবে, গত ৭০ বছর ধরে কী হচ্ছিল?''
রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত মার্চ পর্যন্ত ৮ দশমিক ৯ কোটি সংখ্যক ১০০০ টাকা (৮,৯০০ কোটি টাকা মূল্যের) ব্যাংকে ফেরেনি৷ মার্চের শেষে বাজারে চালু ছিল মোট ৬৩২.৬ কোটি সংখ্যক ১০০০ টাকার নোট (৬,৩২,৬০০ কোটি টাকা মূল্যের)৷ নভেম্বরে নোট বাতিলের পর ছাড়া হয় নতুন ২০০০ টাকার নোট৷ মার্চের শেষে বাজারে চালু মোট অর্থের অর্ধেকেরও কিছু বেশি ছিল এই ২০০০ টাকার নোটে৷ নোট ছাপার খরচের তথ্যও দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক৷ ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে অঙ্কটা ৭,৯৬৫ কোটি৷ আগের অর্থবর্ষের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি৷ তার মানে ফেরত না আসা টাকায় যেটুকু লাভ, তারও অনেকটা চলে গেছে নোট ছাপতে৷
বছরখানেক আগে মমতা ব্যানার্জি যা বলেছিলেন, কেন্দ্রের নোট বাতিল নিয়ে এখন তা-ই শোনা যাচ্ছে কংগ্রেস, সিপিএম-সহ অন্য বিরোধীদের গলায়৷ বুধবার রিজার্ভ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট পেশের পর নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিল নিয়ে বিরোধীরা বলছেন, ‘স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি'৷ অন্যদিকে কংগ্রেস বলছে, দায় মেনে নিন প্রধানমন্ত্রী নিজে৷ আরবিআই-এর তথ্য সামনে আসার পর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ নোট বাতিলকে ‘ফ্লপ শো' আখ্যা দিয়েছেন তিনি৷
ডেরেক ও'ব্রায়েনের মতে, ‘‘অতীতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধীর সরকার পড়ে গিয়েছিল ‘নসবন্দীর' জন্য৷ এবার মোদী সরকারের পতনের কারণ হবে নোটবন্দী৷ বিরোধী আসনে বসবে বিজেপি৷''
আপনার কী মনে হয়? মোদীর নোট বাতিল করার সিদ্ধান্তটি কি ঠিক ছিল? লিখুন নীচের ঘরে৷