পাকিস্তানের ‘দুই কান’ কাটা?
১ নভেম্বর ২০১৭বাংলাদেশে পাকিস্তানি দূতাবাস সর্বশেষ তাদের ফেসবুক পেজে একটি ভিডিও শেয়ার করা নিয়ে আবারো বিতর্কে জড়িয়েছে৷ আর ওই ভিডিও’র কথা হলো, ‘‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নন, জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক৷ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি, তিনি শুধু স্বায়ত্বশাসন চেয়েছিলেন৷’’
পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স নামে একটি ফেসবুক পেজে প্রকাশিত ওই ১৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি ভিডিও গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তান হাইকমিশনের ফেসবুক পেজে শেয়ার করা হয়৷
সংবাদ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে মঙ্গলবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানের হাইকমিশনার রাফিউজ্জামান সিদ্দিকিকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়৷ পাকিস্তানি হাইকমিশনারের কাছে আনুষ্ঠানিক কড়া প্রতিবাদপত্রও দেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব কামরুল আহসান৷ এরপর পাকিস্তান দূতাবাসের ফেসবুক পেজ থেকে ওই ভিডিওটি সরিয়ে ফেলা হয়৷ কিন্তু পাকিস্তান অ্যাফেয়ার্স নামের ফেসবুক পেজে এখনো ভিডিওটি আছে৷
ভারপ্রাপ্ত সচিব মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘শেয়ার করা ভিডিও লিঙ্কটি দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে৷ ইতিহাস পরিবর্তনশীল নয়৷ যেটা বাস্তবতা, সেটা সবাইকে মেনে নিতে হবে৷ তারা যদি ইতিহাস বিকৃতি অব্যাহত রাখে, সেটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর হবে৷’’
কামরুল আহসান বলেন, ‘‘যে লিঙ্কটি তারা শেয়ার করেছে, সেটি তারা ডিলিট করে দিয়েছে এবং লিঙ্কটি শেয়ার করার জন্য তারা দুঃখপ্রকাশ করেছে৷ তারা বলেছে, এটা ইচ্ছাকৃত কোনও ঘটনা ছিল না৷ আমরা তাদের বলেছি, তারা যেন ওয়েবসাইটে দুঃখপ্রকাশ করে৷ দেখা যাক, কী হয়৷’’ তবে বুধবার পর্যন্ত তারা ওয়েবসাইটে দুঃখ প্রকাশ করেনি৷
পাকিস্তান, পাকিস্তানের দূতাবাস ও কূটনীতিকদের নিন্দিত অতীত
১. কূটনীতিক বহিষ্কার
২০০০ সালে পাকিস্তানের ডেপুটি হাই কমিশনার ইরফান-উর রাজাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এক সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করার কারণে৷
২. যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখনই জামায়াতের কোনো নেতা একাত্তরের অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়েছেন, তখনই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও ইমরান খানের দল তেহরিক-ই ইনসাফ, তার প্রতিবাদ করেছে৷ জামায়াত নেতাদের ফাঁসির নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবও পাস হয়েছে৷
৩. জঙ্গিদের মদতদাতা পাক কূটনীতিক
২০১৫ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তানি দূতাবাসের কনস্যুলার কর্মকর্তা মাজহার খানকে বহিস্কার করা হয়৷ তিনি জঙ্গিদের কাছে জাল টাকা হস্তান্তর করার সময় গুলশানের এক হোটেলে গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়েন৷
৪. বহিষ্কৃত আরেক ‘জঙ্গিবান্ধব’ কূটনীতিক
২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে ঢাকা থেকে বহিস্কার করা হয় আরেক পাকিস্তনি কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে৷ ওই ঘটনার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানও বাংলাদেশের এক নারী কূটনীতিককে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করেছিল৷
পাকিস্তান এবং পাকিস্তান দূতাবাস বারবার এমন করলেও বাংলাদেশ কেন তা মেনে নিচ্ছে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘‘আমরা মেনে নেইনি৷ এ ধরনের কাজ তারা আগেও করেছে৷ সেটি আজকেও আমরা তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘তারা এমন ঘটনার পর প্রতিবারই দুঃখপ্রকাশ করে৷ কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করে, সে কি আপনার কথা শুনবে? তবে আমাদের দরকার কূটনৈতিক প্রতিবাদ, সেটিই আমরা করেছি৷ এবং তারা যদি সীমার বাইরে চলে যায়, তাহলে তার জন্যও অনেক পথ রয়েছে৷’’
এ প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কুটনীতিক মোহাম্মদ জমির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাকিস্তান আবারো ঔদ্ধত্ব দেখিয়েছে৷ তারা ইচ্ছা করেই বঙ্গবন্ধুকে হেয় করতে ওই ভিডিও ছড়িয়েছে৷’’ বাংলাদেশ প্রতিবাদ যেভাবে জানাচ্ছে তা যে ফলদায়ক হচ্ছে না এ বিষয়টি তুলে ধরায় অভিজ্ঞ কূটনীতিক বলেন, ‘‘হ্যাঁ, জানি এ ধরণের কাজ পাকিস্তান বার বার করছে৷ কারণ, যার এক কান কাটা সে রাস্তার কিনার দিয়া হাঁটে, দুই কান কাটা যার সে রাস্তার মধ্যখান দিয়া হাঁটে৷’’
আর ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসির মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পাকিস্তান সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে৷ আর এটা তারা দীর্ঘদিন ধরেই করছে৷ তাদের এই অপতৎপরতা নিয়ে আমাদের পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়েছে৷ আর আমরা ২৫ মার্চকে এখন গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করছি৷ কিন্তু এবার যে কাজটি করল তা জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন৷ কূটনৈতিক শিষ্টাচারবিরোধী৷ আমাদের প্রতিবাদে তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে৷ কিন্তু তাদের এটা একটা কৌশল৷ তারা বারবার একই কাজ করে৷ আবার দুঃখ প্রকাশ করে৷ তাই বাংলাদেশের উচিত হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে বসেই পাকিস্তানি কুটনীতিকরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়৷ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত৷ তাদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করার দাবি করছি৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে লিখুন...