‘রাজনীতি', নাকি ‘জঙ্গি তৎপরতা'?
২৬ অক্টোবর ২০১৫
ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে চলতি বছর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনায় আসে বাংলাদেশ৷ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায় খুন হন ফেব্রুয়ারিতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে৷ এরপর একে একে চারজন ব্লগার খুন হলেন যাদের অবস্থান ছিল মৌলবাদের বিরুদ্ধে৷ তাঁরা নাস্তিক এটাও সত্য৷ তবে নাস্তিকদের ‘জবাই’ করতে হবে এমন কোনো ঘোষিত নিয়ম সংবিধান অনুযায়ী ‘সেক্যুলার’ বাংলাদেশে নেই৷
ব্লগারদের হত্যাকাণ্ডের পরে পীরের মুরিদদের জবাই করার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার৷ ব্লগার হত্যার মতো তা ব্যাপক আলোচনায় আসেনি বটে, তবে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কিছুটা পরিষ্কার করে দিয়েছে৷ হিন্দুদের উপর হামলাও চলছে বিরতিহীনভাবে৷ এরইমধ্যে খুন হয়েছেন দুই বিদেশি নাগরিক৷
সর্বশেষ গত শুক্রবার পুরোনো ঢাকার হোসেনি দালানে তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলা চালানো হয়৷ এতে প্রাণ হারায় এক কিশোর, আহত বেশ কয়েকজন৷ বাংলাদেশে শিয়াদের মিছিলে এই হামলা গত চারশ’ বছরের মধ্যে এই প্রথম, জানিয়েছে বিবিসি৷
গত সপ্তাহে কথা হচ্ছিল এক ব্লগারের সঙ্গে৷ তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন, গোড়া ইসলাম, অর্থাৎ যা ‘ওহাবিজম’ বলে পরিচিত, বাংলাদেশে তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে মৌলবাদীরা৷ এরা কার্যত আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’-এর মতাদর্শে বিশ্বাসী৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কিছু দেশ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ দুই বিদেশি হত্যাকাণ্ডসহ শিয়াদের উপর হামলার দায় স্বীকার করেছে ‘ইসলামিক স্টেট’, এমন দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কার্যক্রমের উপর নজর রাখা একাধিক সংস্থা৷
বাংলাদেশ সরকার এবং পুলিশ অবশ্য বাংলাদেশে ‘ইসলামিক স্টেট’-এর উপস্থিতি অস্বীকার করছে৷ যদিও এই পুলিশই অতীতে জঙ্গি গোষ্ঠীটির সমর্থকদের ধরার খবর ফলাও করে জানিয়েছিল৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছেলে ও অন্যতম উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদও বিদেশি পত্রিকায় বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে কথা বলেছেন৷ ইংল্যান্ডকে সতর্ক করেছেন৷
বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রম কতটা বিদেশিদের ছত্রছায়ায় হচ্ছে তা এখনি বলা মুশকিল৷ তবে এটির রাজনৈতিক ব্যবহার বেশ পরিষ্কার৷ বিদেশি হত্যাকাণ্ডের দায় সরাসরি বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তার মিত্র জামায়াতের উপর চাপিয়েছে সরকার৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুতই তাদের কথা বলেছেন৷ যদিও এক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি, কিংবা এত দ্রুত কিভাবে তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী বিএনপি-জামায়াতের সম্পৃক্ততা খুঁজে পেল তারও ব্যখ্যা দেননি৷
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ তিন রকম হতে পারে৷ প্রথমত, সরকারকে বেকায়দায় ফেলা৷ বিএনপি এই মুহূর্তে বেশ নিরব আছে৷ দলটির প্রধান খালেদা জিয়া এখন ইংল্যান্ডে৷ তিনি যখন চিকিৎসা নিচ্ছেন, সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন সেসময় একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে বাংলাদেশে৷ এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ছে সরকার, যা পরোক্ষভাবে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির জন্য লাভজনক৷ বিএনপি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত না ধরে নিলেও কিছুটা লাভ তাদের হচ্ছে৷
দ্বিতীয়ত, এসব ঘটনার অযুহাতে আরো বেশি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তারের সুযোগ পাচ্ছে পুলিশ৷ সরকার তাদের উপর দায় চাপাচ্ছে, ফলে পুলিশ দেদারছে গ্রেপ্তার করছে বিরোধী দলের সাবেক এমপি, কর্মীদের৷ এই দিকটা চিন্তা করলে লাভ হচ্ছে সরকারের৷ ঘটনা যারাই ঘটাক, বিরোধী দলকে দমনে তা বেশ কাজে আসছে৷
তৃতীয়ত, রাজনীতির এই খেলায় তৃতীয় কোনো পক্ষ লাভবান হচ্ছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়৷ বাংলাদেশে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট৷ ফলে কার্যত একতরফা নির্বাচন জয় করে বর্তমানে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ৷ এরকম এক নির্বাচন জয়ের পর ক্ষমতায় টিকে থাকতে অনেকক্ষেত্রেই ছাড় দিচ্ছে দলটি৷ বিশেষ করে উগ্র ইসলামপন্থি গোষ্ঠী হেফাজতে ইসলাম, যারা নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবি করেছে ২০১৩ সালে এবং ‘ইসলামিক স্টেট’-এর কর্মকাণ্ডে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছে, তাদেরকে রেলের জমি বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে৷ এমন সমর্থনের সুযোগে বাংলাদেশে ‘ওহাবিজম’ ডানা মেলছে কিনা ভাববার বিষয়৷