বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি চলবেই?
২০ জানুয়ারি ২০১৮শনিবার ভোরে যশোর সদর ও ঝিকরগাছা উপজেলা থেকে এই লাশগুলো উদ্ধার করা হয়৷ একই সাথে ঘটনাস্থল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র, গুলিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের৷ পুলিশ বলছে, নিহত ব্যক্তিদের তারা চেনেন না৷
যশোরের পুলিশ সুপার (এসপি) আনিসুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শনিবার ভোররাতে যশোর-মাগুরা মহাসড়কের নোঙ্গরপুর এলাকায় গোলাগুলি হচ্ছে ৯৯৯ থেকে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশের একাধিক দল সেখানে অভিযান চালায়৷ পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়৷ পরে ঘটনাস্থল থেকে দুই ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়৷''
একইসাথে ঘটনাস্থল থেকে ২টি ওয়ানশুটার গান, ২ রাউন্ড গুলি, ৫টি কার্তুজ, ৫টি ধারালো অস্ত্র, দড়ি, স্যান্ডেলসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি৷
একই সময় ঝিকরগাছা উপজেলার চাপাতলা মাঠ থেকে আরো দুই জনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ সেখানেও ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র, গুলিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে৷ এই ৪ জনের কারো নাম পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে দাবি আনিসুর রহমানের৷
ঝিকরগাছার ঘটনায় পুলিশের ভাষ্য হল, গ্রামবাসীর মাধ্যমে ডাকাত পড়েছে এমন সংবাদ পেয়ে পুলিশ উপজেলার চাপাতলা মাঠে অভিযান চালায়৷ এ সময় সেখান থেকে অজ্ঞাতপরিচয় দুই ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে৷ পুলিশের ধারণা, ডাকাতির পণ্য ভাগাভাগি নিয়ে দু'গ্রুপের বিরোধে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে৷
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে যশোরের স্থানীয় এক সাংবাদিক টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথমে নিহতদের ডাকাত বলেই ধারণা করেছিলাম৷ পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, এই ৪ জনের ঘটনার সঙ্গে পুলিশের একটা যোগসূত্র আছে৷ তবে এরা কোন এলাকার মানুষ সেটা আমরা নিশ্চিত করতে পারেনি৷ পরিবারের সদস্যদের পাওয়া গেলে পুরো বিষয়টা আরো পরিষ্কার হওয়া যাবে৷ আমাদের ধারণা, দায় এড়াতে পুলিশ এই কৌশল নিয়ে থাকতে পারে, যাতে তাদের ঘাড়ে কোনো ধরনের দায় না বর্তায়৷ কারণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে নানা ধরনের সমালোচনা হয়৷ এই ধরনের ঘটনায় সমালোচনা থেকে মুক্তি পেতে পুলিশ এই কৌশল নিয়ে থাকতে পারে৷''
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘‘এখন আমরা যে প্রবণতা দেখছি সেটা তো আরো ভয়ঙ্কর৷ যে ব্যক্তিকে ক্রসফায়ারের নামে মেরে ফেলা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে আগে ঘৃণা তৈরি করা হচ্ছে৷ ফলে তার মৃত্যু নিয়ে কেউ যেন প্রশ্ন না তোলে৷ বছর দেড়েক আগে আমরা ঝিনাইদহে দেখলাম একজন ব্যক্তিকে আগে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে৷ কয়েকদিন পর ট্রাক চাপায় তার মৃত্যু হল৷ এরপর প্রচার করা হলো, সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে৷ আর যশোরে যেটা হল সেটা তাদের আরেক কৌশল৷ এভাবে নিয়মিত তারা কৌশল বদল করছে৷ যেটা একটা সভ্য দেশে কোনভাবেই চলতে পারে না৷''
এদিকে, বাংলাদেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছেই৷ দু'দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এক রিপোর্টে অভিযোগ করে বলেছে যে, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার৷
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত সংস্থাটির ‘ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট ২০১৮'-তে বাংলাদেশের মানবাধিকারের কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ সংস্থাটি জানিয়েছে, বাংলাদেশের অনেকগুলো গুমের ঘটনা ঘটেছে৷ বিরোধী দলীয় সমর্থক ও সন্দেহভাজন জঙ্গি-উভয়কেই টার্গেট করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশীয় অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘‘বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ডে ভালো কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ যেহেতু দেশটিতে ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে, তাই এই সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিন্নমতকে দমনের প্রচেষ্টাও বন্ধ করতে হবে৷''
৯০টিরও বেশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তারা ৬৪৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন তারা তৈরি করেছে৷
বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘কোন সভ্য দেশে এটা চলতে পারে না৷ আমরা বারবার বলছি, তারপরও এটা বন্ধ হচ্ছে না৷ বিষয়টা এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সত্যিকারের কোনো বন্দুকযুদ্ধও মানুষ বিশ্বাস করছে না৷''
ডয়চে ভেলেকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রেও এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷ আমরা সরকারের প্রতি বারবার অনুরোধ করছি, এটা বন্ধ করুন৷ এতে দেশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে৷ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দেয়া সরকারের দায়িত্ব৷ সেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় উদ্বেগের মধ্যে সময় পার করছে৷ এটা হতে পারে না৷''
মানবাধিকার কর্মীদের সঙ্গে কি আপনি একমত? মন্তব্য করুন নিচের ঘরে৷