‘বিয়ের প্রলোভনে’ যৌন সম্পর্ক কি ধর্ষণ, নাকি প্রতারণা?
২৪ অক্টোবর ২০২০বাংলাদেশে সম্প্রতি আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হলেও ধর্ষণের সংজ্ঞা একই আছে৷ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ৯(১)-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ‘‘যদি কোন পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত [ষোল বছরের] অধিক বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করে, অথবা [ষোল বছরের] কম বয়সের কোন নারীর সহিত তাহার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলে গণ্য হবেন৷’’
এই আইনে স্পষ্ট যে ১৬ বছরের নীচে হলে নারীর সম্মতি থাকলেও তা ধর্ষণ৷ কারণ নারী প্রাপ্তবয়স্ক নয়৷ তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা নেই৷ কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়েও কিছুক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান মনে করেন, ‘‘ধর্ষণে যে জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগের বিষয় থাকে তা এখানে অনুপস্থিত৷ প্রেমের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে যখন শারীরিক সম্পর্ক হয় তখন সেটা ধর্ষণ নয়৷ কিন্তু পরে যখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয় না তখন ধর্ষণ মামলা করা হয়৷ আমার বিচেনায় এটা প্রতারণা৷ আমার মনে হয় আইনে এটার ব্যাখ্যা এবং আলাদা শাস্তির বিধান থাকা উচিত৷’’
তিনি বলেন, ‘‘ভারতীয় আদালতের রায়েও এটা পরিস্কার করা হয়েছে৷ সেখানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে প্রেমের সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মতিতে দৈহিক মিলন হলে সেটা ধর্ষণ হবে না৷ আমাদের এখানেও আশা করি কোনো মামলায় আদালত এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন বা আইনের সংশোধন হবে৷’’
মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘প্রেমের সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মতিতে দৈহিক মিলনের পর বিয়ে করতে অস্বীকৃতি বড় ধরনের প্রতারণা৷ তবে আমার বিবেচনায় এটা ধর্ষণ নয়৷ বাংলাদেশের দণ্ডবিধিতে এই ধরনের প্রতারণার বিচার ও শাস্তির বিধান আছে৷ কিন্তু যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এটা ধর্ষণ তাই দণ্ডবিধির ওই ধারায় কেউ মামলা করেন না৷ সরাসরি ধর্ষণ মামলা করেন৷’’
দণ্ডবিধির ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিবাহিত বলে বিশ্বাস করান, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন, তবে অপরাধী সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে৷ আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন, এই আইনটি মামলা দায়ের বা চার্জশিটের সময় বিবেচনা করা যায়৷
ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে
এদিকে ২২ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চ ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন৷ ওই আসামি ১২ বছর ধরে জেলে আছেন৷ আদালত তাকে জামিন না দিয়ে জেল গেটে বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন৷
২০১১ সালে মেয়েটির বয়স যখন ১৪ বছর তখন বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে আসামি৷ মেয়েটি অন্তঃস্বত্ত্বা হয়ে পড়লে বিয়ের প্রতিশ্রুতির কথা অস্বীকার করেন তিনি৷
সালিশের মাধ্যমেও বিষয়টি মীমাংসা না হওয়ার পর ওই বছরের ২৫ অক্টোবর ধর্ষণ মামলা হয়৷ ২০১২ সালে ১২ জুন রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রায়ে আসামিকে যাবজ্জীবন কারদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে৷
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী জানান, ২২ অক্টোবর আসামি আইনজীবীর মাধ্যমে উচ্চ আদলতে হাজির হয়ে ওই নারীকে এখন বিয়ে করবেন বলে জামিন চান৷ ওই নারীরও বিয়েতে সম্মতির কথা জানানো হয়৷ তাদের একটি শিশু সন্তানও আছে৷ আসামি আদালতে তার পিতৃত্বও স্বীকার করেন৷ আদালত তাকে জামিন না দিয়ে জেলগেটে বিয়ের আয়োজন করতে কারা তত্ত্বাবধায়ককে নির্দেশ দেন৷ বিয়ের পর জামিনের বিষয় বিবেচনা করা হবে৷
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘‘ধর্ষণ মামলা আপোষযোগ্য নয়৷ তবে হাইকোর্টের ক্ষমতা আছে তারা তাদের বিবেচনায় যেকোনো আইনগত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন৷’’
তিনি জানান, ‘‘এখানে ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি বহাল আছে৷ তাকে জামিনও দেয়া হয়নি৷ শুধু জেলগেটে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ আমার মনে হয়েছে আদালতের এই আদেশ ভালো হয়েছে৷’’
এই বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মন্তব্য না করে অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘‘ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে আমি মেনে নিতে পারি না৷ এতে সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট হয়৷ কারণ আসামি শুধু বাঁচার জন্য বিয়েতে রাজি হতে পারেন৷ তিনি বিয়ে করলে তো আগেই বিয়ে করতে পারতেন৷ আর এটার সুযোগ তৈরি হলে কেনো নারীও কোনো পুরুষকে বিয়ে করার জন্যও এই ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারেন৷’’
আর ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার নারীর বিয়ে ওই নারীর মধ্যে নতুন করে মানসিক সংকটও তৈরি করতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
ওই মেয়েটি বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে যখন দৈহিক সম্পর্কে জড়ান তখন তার বয়স ছিলো ১৪ বছর৷ সে তখন অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় আইনে তার সম্মতি কোনাভাবেই সম্মতি হিসেবে গণ্য নয়৷
অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘হাইকোর্ট কোন প্রেক্ষাপটে আদেশটি দিয়েছেন তা আমার কাছে এখনো স্পষ্ট নয়৷ পুরো আদেশটা যখন বের হবে তখন সেটা বোঝা যাবে৷ তার আগে এটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না৷ তবে সাধারণভাবে ধর্ষণের শিকার নারীর সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ে হতে পারে না৷ এটা আপোষ মীমাংসাও করা যায় না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাধারণভাবে বিয়ে করতে তো কোনো বাধা নেই৷ কিন্তু এটাতো স্বাভাবিক বিয়ে নয়৷ তাই এটা নিয়ে অনেক কিছু ভাবার আছে৷’’