একটা সময় ছিল, যখন সেলফোন ছিল না, ইন্টারনেট ছিল না, ফোন বলতে ল্যান্ড লাইন, সেটাও সবার ঘরে ছিল না। বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে সেটা আদি প্রস্তরযুগ মনে হতে পারে, কিন্তু তখন সংবাদপত্রের রমরমা ছিল দেখার মতো। মানুষের কাছে খবরের কাগজই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যম। কারণ, টিভিতে তখন সরকারি খবরের বাইরে রাশি রাশি চ্যানেল তৈরি হয়নি।
সেই সময়ের একটা ঘটনা বলি। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় তখন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গঠন করেছেন। বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাবার পর আবার একটি দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে সরকার ও এনডিএ ছেড়ে কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। সেই সময় একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, তৃণমূল-কংগ্রেস জোট জিতবে। বামেদের চূড়ান্ত হার হবে। এমনও শোনা যায়, তিনি তার দপ্তরে একজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে বসে মন্ত্রিসভায় কে কে থাকবে, সেই তালিকাও তৈরি করে ফেলেছিলেন। স্বাভাবিকভাবে তার প্রতিফলন সেই খবরের কাগজেও পড়েছিল। অধিকাংশ আসনেই তৃণমূল-কংগ্রেস প্রার্থীদের এগিয়ে রাখা হয়েছিল।
বাস্তবে সেবার তৃণমূল পেয়েছিল ৬০টি আসন এবং কংগ্রেস ২৬টি। আর সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট পায় ১৯৬টি আসন। তবে সিপিএম একার ক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এরপর ভোটদাতাদের উপর সংবাদপত্রের প্রভাব কতটা তা নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।
সময় বদলেছে। প্রথমে ঘরে ঘরে রঙিন টিভি ঢুকেছে। কালক্রমে ইংরেজি, হিন্দি ও আঞ্চলিক ভাষায় অসংখ্য নিউজ চ্যানেল হয়েছে। আর মানুষ যা চোখে দেখে সেটা অন্ধের মতো হুবহু বিশ্বাস করে। টিভি-র পর্দায় যা দেখানো হয়, সেটাই বিশ্বাসযোগ্য এমন ধারণা তৈরি হতে থাকে।
তারপর এলো ডিজিটাল যুগ। সিংহভাগ মানুষের হাতে স্মার্টফোন। তাতে ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মতো হরেক প্ল্যাটফর্ম। সেখানে ভিডিও, ছবি সমানে আপলোড করা হচ্ছে। অসংখ্য ইউটিউবার তাদের চ্যানেল নিয়ে হাজির। সবকটি সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলও সামাজিক মাধ্যমে চলে এসেছে। হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালে ভারতে ২০ লাখ ইউটিউবার ছিলেন, যাদের সাবসক্রাইবারের সংখ্যা এক লাখের বেশি। প্রতি বছর সংখ্যাটা ৪৫ শতাংশ বাড়ছে। ইউটিউবার যাদের চ্যানেল মনিটাইজড হয়েছে, তারা ২০২০ সালে ভারতের অর্থনীতিকে ছয় হাজার আটশ কোটি টাকা দিয়েছে। প্রায় সাত লাখ মানুষ পুরো সময়ের কাজ পেয়েছেন এই ইউটিউব থেকে।
এই সংখ্যাতত্ত্বটা দিতে হলো ইউটিউবারদের প্রভাব বোঝাতে। আগে টিভির ক্ষেত্রে মানুষের যে বিশ্বাস ছিল, এখন তা রয়েছে এই ইউটিউবারদের ক্ষেত্রে। তারা যা দেখাচ্ছেন, লাইভ করছেন, তা মিথ্যা হতে পারে না। ক্যামেরার লেন্স মিথ্যা বলতে পারে না। আর এই বিশ্বাসকে পুঁজি করে মানুষকে পাশে পেতে রাজনৈতিক দলগুলি যে ঝাঁপাবে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। টিভি চ্যানেলগুলোও তাদের খবর নিয়ে চলে আসছে ইউটিউবে।
৫০ হাজার বা তার বেশি সাবসক্রাইবার আছে এমন ইউটিউবারদের কদর খুব বেশি। এদের অনেকেই রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে ভিডিও আপলোড করেন। ফলে তাদের কাছে পৌঁছে যায় রাজনৈতিক দলগুলি। আর এসব কাজ তো শুধু শুধু হয় না। নিন্দুকরা বলে, 'ভিটামিন এম' ছাড়া এসব ক্ষেত্রে কোনো কাজ হওয়ার না। সেজন্যই তো রাজনৈতিক দলগুলির ভোটবাজেট ক্রমশ আকাশছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।
হতেই পারে। টিভি চ্যানেল, সামাজিক মাধ্যম, সংবাদপত্র কত জায়গায় প্রভাব বিস্তার করতে হয় দলগুলিকে। নিজেদের কথা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রচার করতে হয়, তার কী ঠিক আছে। মুশকিল হলো, সাধারণ মানুষ তো ফাইনাল প্রোডাক্ট দেখবেন। তারা কী করে বুঝবেন, কোনো খবরের পিছনে রাজনৈতিক দলের প্রভাব আছে কি না, কোথাও ভিটামিন এম কাজ করছে কি না, কোথাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপ কাজ করছে কি না। এখন প্রচারের দুনিয়া সামলান পেশাদাররা। এটা আর অ্যামেচারদের জায়গা নেই। সমাজতাত্ত্বিক, মনোবৈজ্ঞানিক, নেটবিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিশেষজ্ঞ সকলে মিলে ঠিক করছেন কৌশল। তার জন্য একের পর এক সমীক্ষা চালানো হচ্ছে। এ সবের জন্য বিপুল পরিমাণ ডেটাবেজ দরকার হয়। সেসব পয়সা দিয়ে কিনতে হয়। আমাদের সকলের ডেটা বিক্রি হয়। সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে কৌশল ঠিক করতে হয়, বিশেষ শ্রেণির মানুষকে কীভাবে প্রভাবিত করতে হবে। বিষয়টা যত সহজে বলা হলো, আদতে ততটাই কঠিন এবং পুরোপুরি বৈজ্ঞানিক ও মনোবৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্য়ে তা তৈরি হয়।
ভোটকুশলীদের যে কয়েকশ বা হাজার কোটির বেশি টাকা দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি রাখে, তার পিছনে তো কারণ আছে। সামাজিক মাধ্যম হলো এমন একটা জায়গা যার উপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু সংবাদপত্র ও টিভি-র উপর তো আছে। কিন্তু নির্বাচন এলেই শোনা যায় ফেক নিউজের কথা। গণমাধ্যমের সর্বত্র নাকি ছড়িয়ে থাকে ফেক নিউজ। কে তার হিসাব রাখে!
নির্বাচন মানে যুদ্ধ। আর যুদ্ধ মানে ছলে-বলে-কৌশলে জেতার চেষ্টা। আর সেই চেষ্টার অঙ্গ হলো গণমনাধ্যমকে পাশে পাওয়া বা তার সুবিধা পাওয়া। ফলে গণমাধ্যমও আর বিশুদ্ধ থাকে না, থাকতে পারে না। বিশেষ করে এই উপমহাদেশে।