মাদ্রাসা ছাত্রী হত্যাচেষ্টা: অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিলে কারা?
১০ এপ্রিল ২০১৯ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী এখনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে আছেন৷ তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে৷ গত শনিবার তাঁকে তারই মাদ্রাসার ছাদে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷ তাঁর শরীরের ৮০ ভাগেরও বেশি পুড়ে গেছে৷ উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেয়ার কথা থাকলে এই মুহূর্তে তা সম্ভব হচ্ছে না৷
বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বুধবার সাংবাদিকদের জানান, ‘‘আজ (বুধবার) সকালে তাঁকে নিয়ে আমরা আবারও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করেছি৷ তাঁরা আমাদের কাছে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেয়েছেন৷ আমরা তা পাঠিয়েছি৷ সেখানকার মেডিকেল বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রোগীর এখন যে অবস্থা, তাতে তাঁকে জার্নি করে সিঙ্গাপুরে নেয়া কঠিন হবে৷ তাঁকে বিদেশে নেয়ার ব্যাপারে আরও অপেক্ষা করা উচিত৷’’
এরইমধ্যে বার্ন ইউনিটে ওই ছাত্রীর একটি অপারেশন করা হয়েছে৷ এর মাধ্যমে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘‘তাঁর শরীরের চামড়াটা ফুটো ফুটো হয়ে যাওয়ায় সে শ্বাস নিতে পারছিল না৷ আমরা অপারেশন করে শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছি৷ তাঁর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে৷ আর ফুসফুস ও কিডনি কার্যকর আছে৷’’
রিমান্ডে অধ্যক্ষ
মামলার প্রধান আসামি ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজউদ্দৌলা আগে থেকেই কারাগারে আছেন৷ তিনি এই ছাত্রীকেই গত ২৭ মার্চ নিজ কক্ষে যৌন হয়রানি করেন বলে অভিযোগ৷ ওই দিনই ছাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়৷ ওই ছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার মামলায়ও অধ্যক্ষসহ আট জনকে আসামি করা হয়৷ অজ্ঞাত পরিচয় আসামিও রয়েছে৷ পুলিশ আদালতের মাধ্যমে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে৷ মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা আরো পাঁচ জনকে পাঁচ দিন করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত৷ তাদের মধ্যে মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক আফছার হোসেন ও ছাত্রীর সহপাঠী আরিফুর ইসলাম রয়েছে৷
মামলার এজাহারে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করায় ছাত্রীটিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়৷ এর আগে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়া হয়েছে৷
এই অধ্যক্ষ আগেও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন৷ তার বিরুদ্ধে নাশকতা ও নানা অভিযোগে আরো ৬টি মামলা আছে বলে জানা গেছে৷
কার কী ভূমিকা ছিল
ছাত্রীর ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান ডয়চে ভেলের কাছে অভিযোগ করেন, সোনাগাজী থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনও অধ্যক্ষের পক্ষ নিয়েছিলেন৷ তিনি ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনাকে ‘নাটক' বলে অভিহিত করেছিলেন৷ ‘‘আমার বোনের নিরাপত্তাহীতার কথা জানানোর পরও কোনো নিরাপত্তা দেয়া হয়নি,'' বলেন তিনি৷
এদিকে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার পর ওসি প্রকাশ্যেই সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন যে, এটা আত্মহত্যার চেষ্টাও হতে পারে৷ তবে বুধবার তিনি ডয়চে ভেলের কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ তিনি দাবি করেন, ‘‘শনিবারের বিষয়টিকে আমি আত্মহত্যা চেষ্টার ঘটনা বলিনি৷ আর ২৭ মার্চ ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনাকেও আমি নাটক বলিনি৷ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি৷''
ওসির বিরুদ্ধে মামলার এজাহার পরিবর্তনের চেষ্টারও অভিযোগ আছে৷ তিনি ছাত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার ঘটনার প্রতিবাদে যাতে কোনো মিছিল বের না হয় সেজন্যও তৎপর ছিলেন বলে অভিযোগ৷
ওসি অভিযোগ অস্বীকার করলেও বুধবার তাকে এইসব অভিযোগে বদলি করা হয়েছে৷ আর মামলার তদন্ত থানাকে বাদ দিয়ে ‘পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন'কে দেয়া হয়েছে৷
এদিকে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান হলেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক টি কে এনামুল করিম৷ ২৭ মার্চ অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হলেও তার বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷ ছাত্রীটিকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টার পর তড়িঘড়ি করে সোমবার অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷ এর আগে ১০ দিনেও তার বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হলো না জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম৷ আর একটা ঘটনার পর এখন আমরা জানছি যে, আগেও অনেক অপরাধ করেছে, আগেতো জানতাম না৷’’
ছাত্রীর নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ কেন নেয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমরাতো আসি আর যাই৷ আমাদের কাছে এত খোঁজ থাকেনা৷’’
অধ্যক্ষকে রক্ষায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ?
অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ফুলগাজী উপজেলা জামায়াতের আমীর ছিলেন৷ তিন বছর আগে মামলাসহ নানা অভিযোগে তাকে জামায়াত থেকে বহিষ্কার করা হয়৷ এরপর আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয়ে তিনি অধ্যক্ষের পদ টিকিয়ে রাখেন৷ জামায়াত থেকে বহিষ্কারের পর প্রথমে তিনি পৌর আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ মামুনের সহায়তা নেন৷ এরপর মামুনকে বাদ দিয়ে তিনি আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের সহায়তা নেন৷ মাকসুদ মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সদস্য৷
মাদ্রাসাটির মালিকানায় শহরে তিন তলা একটি মার্কেট আছে, যা থেকে মাসে তিন লাখ টাকা আয় হয়৷ এছাড়া মাদ্রাসার আরো অনেক আয় আছে৷
অধ্যক্ষের পক্ষে মিছিল
২৭ মার্চ যৌন হয়রানির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে অধ্যক্ষ জেলে গেলে পরের দিন ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে শিক্ষার্থীদের একাংশকে দিয়ে মাকসুদ শহরে মিছিল বের করান৷ ওই মিছিলে মাদ্রাসা ছাত্রলীগের সদস্যরাও অংশ নেয়৷ মিছিল শেষে সমাবেশে যৌন হয়রানির মামলাকে মিথ্যা বলে দাবি করা হয়৷ আর তারাই ছাত্রীর পরিবারকে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়৷ অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ নেতা মামুনও কিছু শিক্ষার্থীকে দিয়ে যৌন হয়রানির বিচারের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন৷ তবে কথা বলার জন্য তাদের কাউকেই টেলিফোনে পাওয়া যায়নি৷
অধ্যক্ষের পক্ষে অবস্থার নেয়ার অভিযোগ আছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমীনের বিরুদ্ধেও৷ তিনি মাদ্রাসার গভর্নিং বডির ভাইস প্রেসিডেন্ট৷ তবে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘২৭ মার্চ যৌন হয়রানির পর আমিই মাদ্রাসায় গিয়ে ওসিকে খবর দিয়ে অধ্যক্ষকে আটক এবং মামলার ব্যবস্থা করি৷ তবে ওই ঘটনার পর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ অধ্যক্ষের পক্ষে তার মুক্তির দাবিতে শহরের জিরো পয়েন্টে শিক্ষার্থীদের দিয়ে মিছিল করায়৷ আরেকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর মামুন অধ্যক্ষের কিরুদ্ধে অবস্থান নেয়৷’’
তিনি গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি হিসেবে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘‘আমি উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম৷ আর সহ-সভাপতির তো কোনো পাওয়ার নেই৷’’
রুহুল আমীন বলেন, ‘‘অধ্যক্ষ খারাপ মানুষ, তার বিরুদ্ধে আগেও যৌন হয়রানির অভিযোগ আছে৷ আর পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার আমি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই৷’’