মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সংগঠক ফরিদা আখতার
২০ জুলাই ২০১১‘‘মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় আমার এক ছেলেকে হারিয়েছি৷ পাক সেনারা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিল৷ সেই গুলি আমার মাত্র পাঁচ মাসের শিশুপুত্রের গা ছুঁয়ে গিয়েছিল৷ তবে গুলিটা তার গায়ে লাগেনি৷ কিন্তু পাক সেনাদের গুলি থেকে বাঁচতে আমি যখন দৌড় দিয়েছি তখন ছেলেটা আমার হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল৷ সে ইরিখেতের মধ্যে পড়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করে রেড ক্রসের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি৷ কিন্তু তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি৷'' এভাবেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্ট এবং ত্যাগের কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আখতার৷
১৯৫২ সালের ২৩ মে নারায়ণগঞ্জে জন্ম এই বীর সাহসী নারীর৷ তাঁর বাবা আব্দুর রহমান মিয়া এবং মা বেগম আকরামুন্নেসা রহমান৷ ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন থেকেই বিভিন্ন সংগ্রাম ও আন্দোলনের সাথে জড়িত ফরিদা আখতার৷ ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনসহ অন্যান্য সংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ফরিদা৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন তিনি৷ এসময়ই ছাত্রলীগের ঢাকা জেলার মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগরতলা পাড়ি দেন তিনি৷ পথে নানা ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হন৷ পাক সেনাদের গুলির মুখে পড়ে নিজের শিশু সন্তানকে হারাতে হয়৷ এরপরও নিজের লক্ষ্য থেকে এতোটুকু বিচলিত হননি তিনি৷
আগরতলা জয় বাংলা অফিসে গিয়ে হাজির হন৷ শুরু করেন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম৷ অন্যান্য সংগ্রামী নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী৷ এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন ফরিদা আখতার৷ প্রথমদিকে আগরতলা রেডক্রস সোসাইটির সাথে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেন তাঁরা৷ পরে গোকুলনগর এবং মতিনগর প্রশিক্ষণ শিবিরে অস্ত্রচালনা এবং চিকিৎসা সেবা বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন৷ তবে সেসময় পুরুষ যোদ্ধাদের জন্যও যথেষ্ট অস্ত্র ছিল না বলে সশস্ত্র যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর৷ অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থেকে তাঁদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা দিয়েছেন৷
এরপর বাসে সাময়িকভাবে গড়ে তোলা ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্রে চিকিৎসা সেবার কাজ করতে থাকেন তিনি৷ এছাড়া বিশ্রামগড় হাসপাতাল ও মেলাঘর এবং হাপানিয়া শিবিরের দায়িত্ব পড়ে ফরিদার উপর৷ দীর্ঘ নয়মাসের ঘটনাবহুল দিনগুলোর কয়েকটি স্মৃতি তুলে ধরেন ডয়চে ভেলের কাছে৷ তিনি জানান, ‘‘কসবা সীমান্তে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত অবস্থায় এক মুক্তিযোদ্ধাকে জিবি হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়৷ তার একটা পা এবং একটা হাত কেটে ফেলতে হয়েছিল৷ আমি প্রায় প্রতিদিনই তাকে দেখতে যেতাম৷ তার অবস্থার খোঁজ খবর নিতাম৷ সে তেমন একটা কথা বলতো না৷ প্রায় সময়ই চুপ করে থাকতো৷ কিন্তু একদিন আমাকে কাছে ডেকে বলে যে, ‘আপা, আমার তো শরীর ভালো না৷ সময় শেষ হয়ে আসছে৷ তো আমার এই চিঠিটা কুসুমের কাছে পৌঁছে দেবেন৷' আখাউড়ার একটা ঠিকানা দেওয়া ছিল খামের উপর৷ কিন্তু আমি বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁকে বললাম যে, ‘ঠিক আছে চিঠিটা আমার কাছে থাক৷ আপনি তো সুস্থ হয়ে যাবেন৷ তবে আপনি যদি যেতে না পারেন আমি খবর দেবো যে আপনি অসুস্থ এবং এই হাসপাতালে আছেন৷ কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও প্রয়োজন হলে আপনাকে এখানেই চিকিৎসা করা হবে৷' এরপরই সে আমার কাছে তাঁর কুসুমের গল্প শোনালো৷ যুদ্ধে আসার মাত্র দুই মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছিল৷ সে সময়ই তাকে রেখে যুদ্ধে চলে আসে৷ যাহোক এর কয়েকদিন পর সকাল বেলা সে আমার কাছে ডাব খেতে চাইল৷ কিন্তু আমি অন্য কাজের মধ্যে সেটা ভুলে গিয়েছি৷ পরে হঠাৎ মনে পড়লে তার জন্য ডাব নিয়ে এসে দেখি মাসুদ নামের সেই মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে৷ এই ঘটনা আমাকে খুবই মর্মাহত করে৷ তাকে সেখানেই দাফন করা হলো৷ এরপর আমি তার চিঠিটা খুলে পড়লাম৷ তাতে সে লিখেছিল যে, ‘কুসুম, আমার হাত-পা দুটোই নেই৷ তাই আমি বেঁচে থেকেও কোন লাভ নেই৷ তুমি তোমার মতো নিজের একটা পথ করে নিও৷ বিয়ে করে নিও৷' পরে কুসুমকে আমি খুঁজে বের করে জানলাম যে, অন্য একজনের সাথে তার ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে৷ তবুও আমি চিঠিটা আমি তার হাতে দিলে সে আর্তচিৎকার করে কান্নাকাটি করে৷ এই ঘটনাটি আমাকে সারাজীবন নাড়া দেয়৷''
মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলায় সারদা সেবা সংঘেরও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ফরিদা আখতার৷ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী এনে নারায়ণগঞ্জের মানুষের হাতে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি৷ এছাড়া যুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী লুপ্ত না করে যুদ্ধের পর সেটির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ মহিলা সংঘ৷ মহিলা সংঘের শুরু থেকে এর সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আখতার৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক