মুখ্যমন্ত্রীর কাছে কয়েকটি প্রশ্ন
২৫ মার্চ ২০২২বগটুই-কাণ্ডে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। আর তার ঠিক একদিন আগে ঘটনাস্থলে গিয়ে বেশ কিছু কড়া কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেখানে যত বেআইনি বোমা তৈরি হচ্ছে, সব খুঁজে বার করতে হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। চমৎকার নির্দেশ! প্রশাসনের কাছে এটাই তো প্রত্যাশা। বগটুই গ্রামে বন্ধ বাড়িতে পুড়ে মারা গেলেন যারা, সেই শিশু, নারীরাও এই আশ্বাসবাণীটুকু শুনতে চেয়েছিলেন নিশ্চয় শেষবেলায়! পোড়া লাশগুলো এ কথা শুনে একটু শান্তিতে কবরে যেতে পারবে নিশ্চয়।
মুখ্যমন্ত্রীরকথা শুনতে শুনতে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ভেসে আসছিল কোনো কোনো ঘটনা। কিছু কিছু কথা। অসংখ্য অভিযোগ। ২০১৬ সালের পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে হালের পুরভোট-- বাম, কংগ্রেস, বিজেপি সকলে সমস্বরে অভিযোগ করে গেছে যে, রাজ্যের দিকে দিকে বোমা তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। চোখে ঠুলি পরে না থাকলে গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে প্রায় প্রতিদিন যে রাজনৈতিক সহিসংতার ঘটনা ঘটছে, তা দেখতে-বুঝতে অসুবিধা হয় না। সিসিটিভি ফুটেজে তৃণমূলেরই এক কাউন্সিলরকে হত্যা করার যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, তাতে শরীরের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। প্রকাশ্য রাস্তায় বাইকে বসা কাউন্সিলরকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মেরে দিচ্ছে এক দুষ্কৃতী। একসময় এমন ঘটনা বিহার-উত্তরপ্রদেশে হতো বলে শুনেছি। এখন সেখানেও এমন বেপরোয়া দৃশ্য বড় একটা দেখা যায় না। উত্তরপ্রদেশে অবশ্য আরো ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে। ফলে বিজেপি নেতারা উত্তরপ্রদেশের সঙ্গে বাংলার যে তুলনা টানেন, তা-ও ঠিক নয়।
রাজ্য জুড়ে বোমা তৈরির কারখানার অভিযোগ যখনই বিরোধীরা তুলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রী-সান্ত্রিরা গলা চড়িয়ে তার বিরোধিতা করেছেন। রাজ্যের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীদের বিরুদ্ধে। একের পর এক খুন, গাছে মৃতদেহ ঝুলতে দেখেও আপনারা বলে গেছেন, কোথাও কিছু ঘটছে না। রাজনৈতিক হত্যার কোনো চিহ্নই নেই। আর আপনাদের সেই কথায় আরো আসকারা পেয়েছে 'তাজা' নেতারা। মাথায় অক্সিজেন কম নিয়ে একের পর এক সভায় ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, পুলিশকে বোমা মারা, খুন করে দেওয়ার বক্তৃতা করে গেছেন আপনাদেরই ভাইসম নেতা। তিনি বলেছেন, আর নীচু তলার কর্মীরা করে দেখিয়েছেন। বাড়তে বাড়তে পরিস্থিতি এখন বগটুইয়ে গিয়ে পৌঁছেছে। গণহত্যার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে আপনাদের বিরুদ্ধেও। একসময় বিরোধী হিসেবে শাসকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ তুলতেন আপনারা। এতদিনে বুঝতে পারলেন, এবার লাগাম টানতে হবে? সে জন্যই কি পুলিশকে বোমা উদ্ধার অভিযানে নামতে বললেন মানীয়া মুখ্যমন্ত্রী? মেনে নিতে বাধ্য হলেন যে, রাজ্যজুড়ে এমন বোমা তৈরির অসংখ্য শিল্প গড়ে উঠেছে!
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য পুলিশের ডিজি বাহিনী নামিয়ে দিয়েছেন বোমা উদ্ধারে। কেশপুর থেকে বালতি বালতি বোমা উদ্ধার হয়েছে ইতিমধ্যেই। কী করে এত দ্রুত পুলিশ বোমা উদ্ধার করে ফেলল? তার মানে তাদের কাছে সব খবরই থাকে। এতদিন তারা দেখেও দেখেনি। ঠিক এই অভিযোগটাই তো করছেন বগটুইয়ের গ্রামবাসীরা! বলছেন, একের পর এক বাড়িতে যখন আগুন লাগানো হচ্ছে, পুলিশ তখন ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বসে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। গ্রামের এক কিলোমিটারের মধ্যে এসডিপিও-র বাংলো। কিন্তু তিনি কিছুই দেখতে পাননি। শুনতে পাননি। বুঝতে পারেননি।
আসলে পেরেছেন। পুলিশ প্রশাসন জানে না, এমনটা হয় না। তারা নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। ভাবতে অবাক লাগে, মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার কয়েকমিনিটের মধ্যে বগটুইয়ের অন্যতম অপরাধী গ্রেপ্তার হয়! নির্দেশের আগে পর্যন্ত তার গায়ে হাত দিতে কি ভয় পেয়েছিল পুলিশ? কেন আগেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি?
প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক চাপ থাকে, একথা সবাই জানে। গোটা পৃথিবীতেই একথা কমবেশি সত্য। কিন্তু সেই চাপেরও একটা পর্যায় থাকে! নারী-শিশুদের জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়ার পরেও যদি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতে হয় পুলিশকে, তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে কাকে?
সিবিআই তদন্তে নেমেছে। এমন অনেক সিবিআই তদন্ত দেখেছি আমরা। দেখেছি ভোটের আগে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে সিবিআই কেমন বিভিন্ন মামলা নিয়ে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে ওঠে, তারপর আবার ঝিমিয়ে যায়। দেখেছি, কীভাবে চোখের জল ধীরে ধীরে ফল্গুনদীর মতো শুকিয়ে যায়। আমরা কেবল একের পর অবিশ্বাসের নাম যোগ করতে থাকি খাতায়-- বরানগর, মরিচঝাঁপি, ছোট আঙারিয়া, কেশপুর, নন্দীগ্রাম, নেতাই, পুরুলিয়া, কামদুনি, বগটুই...
পাতা ভরতে থাকে। ভরতেই থাকে।