নিজামীর ফাঁসি কার্যকর
১০ মে ২০১৬মতিউর রহমান নিজামী হলেন চতুর্থ জামায়াত নেতা যাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়া হলো৷ এ পর্যন্ত মোট ফাঁসি দেয়া হয়েছে পাঁচজনকে৷ গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ নিজামীর মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে রিভিউ আবেদন বাতিল করার পর, ফাঁসি কার্যকর করা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র৷
নিজামীর ফাঁসি কার্যকর করার পর পরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক জামিউল আহসান শিপু ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীই রাত ১২টা ১০ মিনিটে নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার খবর জানান৷ পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা শেষে পুলিশ পাহারায় নিজামীর লাশ তার গ্রামের বাড়ি পাবনার সাঁথিয়ায় নেয়া হবে৷ সেখানেই তাকে দাফনের কথা রয়েছে৷’’
ফাঁসির ঠিক আগের কয়েকটা মুহূর্ত
১০ মে ২০১৬
দুপুর ২:০০ – জানা যায় নিজামী প্রাণভিক্ষা চাইবেন না৷
বিকেল ৪:০০ – জল্লাদ রাজুর কারাগারে প্রবেশ
রাত ৮:০০ – কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করার আদেশ
রাত ৮:৪৫ – কারাগারে নিজামীকে শেষ দেখা দেখতে যান তাঁর স্বজনরা
রাত ৯:৩০ – নিজামীর সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে যান স্বজনরা
রাত ১০:০০ – জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জনসহ ঊর্ধতন কর্মাকার্তাদের কারাগারে প্রবেশ
রাত ১০:৩০ – কারা ফটক এবং আশপাশের নিরপত্তা আরো জোরদার
রাত ১২:১০ – ফাঁসি কার্যকরের খবর জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
রাত ১২:১৫ – কারাকর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে ফাঁসি কার্যকর করার কথা জানায়
রাত ১:৩০ – কারাগার থেকে নিজামীর লাশ বের করে পাবনার পথে রওয়ানা হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী
নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের জন্য সারাদেশের নিরাপত্তা জোরদার ছিল৷ তারপরও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিপূল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ ভিড় করেন৷
তার আগে দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, ‘‘নিজামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে না৷ তাই ফাঁসি কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র৷ কারাকর্তৃপক্ষ ফাঁসি কার্যকর করতে প্রস্তুত৷’’
ফাঁসির আগে মঙ্গলবার রাতে নিজামীর স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করেন৷ পরিবারের মোট ২২ জন সদস্যকে দেখা করার সুযোগ দেয়া হয়৷ বেরিয়ে যাওয়ার সময় তার স্বজনরা ইংরেজি ‘ভি’ চিহ্ন দেখান৷ তবে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে তাঁরা কেউ কথা বলেননি৷
মানবতাবিরোধী অপরাধের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয় রবিবার রাতে৷ সোমবার রিভিউয়ের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ারা পর তা ট্রাইব্যুনাল হয়ে কারাগারে যায় একই দিনে৷ আর সেদিন রাতেই কারাকর্তৃপক্ষ তাকে রায় পড়ে শোনান৷
এরপর গত ৫ মে বৃহস্পতিবার নিজামীর রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ৷ প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের এই বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী৷
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাবনায় হত্যা, ধর্ষণ, বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার দায়ে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর নিজামীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ এই রায়ের বিরুদ্ধে নিজামী আপিল করলে গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর শুনানি শুরু হয়৷ গত ৬ জানুয়ারি আপিলে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ৷ তারপর রিভিউ আবেদনও খারিজ হয় গত বৃহস্পতিবার৷
২০১০ সালের ২৯ জুন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের একটি মামলায় মতিউর রহমান নিজামীকে আটকের পর একই বছরের ২ অগাস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷
১৯৯১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় তিনি শিল্পমন্ত্রী ছিলেন৷ এছাড়া একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি জাময়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি এবং আলবদর কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন৷ আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে মূল ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ৷
নিজামীর ফাঁসি বাতিল বা স্থগিত করে রায় পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিল হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আরো কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন৷
২০০৯ সালে মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়৷ ট্রাইব্যুনালের রায় অনুযায়ী ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ আরেক জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে ফাঁসি দেয়া হয় ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল৷ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর৷ আর সর্বশেষ বুধবার ( ১১ মে, ২০১৬) জামায়াতের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হলো৷
প্রসঙ্গত, নিজামী আরো একটি মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ছিলেন৷ ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মতিউর রহমান নিজামীসহ ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত৷ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল গভীর রাতে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড বা সিইউএফএল জেটিঘাটে ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র৷ নিজামী ঘটনার সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী ছিলেন৷