রেমিটেন্স প্রবাহ কমার নেপথ্যে
৯ জুন ২০১৭বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে এক সংসদ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জানান, ‘‘২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যাংকিং চ্যানেলে ৮১ হাজার ১০৮ কোটি টাকা রেমিটেন্স এসেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ হাজার ৭৩৫ টাকা কম৷ ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে রেমিটেন্স আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা৷''
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে প্রবাসীরা ১ হাজার ৩৬১ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন, যা ২০১৫ সালের তুলনায় ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ কম৷
এর আগে ২০১৩ সালেও প্রবাসীরা তার আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৩৯ শতাংশ কম রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন৷ গত কয়েক বছর ধরে বৈধ চ্যানেলে বাংলাদেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ধসের ধারা স্পষ্ট৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হতে পারে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠাতে আগ্রহ কমে যাওয়া৷ প্রবাসী কর্মীরা ‘বিকাশ', হুন্ডিসহ নানা উপায়ে দেশে টাকা পাঠাতে আগের চেয়ে বেশি উৎসাহ বোধ করছেন৷ কারণ, ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কম৷
জনশক্তি রপ্তানি বিশ্লেষক হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রবাসী শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়াও রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ৷ সৌদি আরবে কাজ করতে নতুন যাওয়া শ্রমিকরা এখন সর্বোচ্চ ৬ থেকে ৮শ' রিয়াল আয় করতে পারেন, যা আগের তুলনায় অনেক কম৷ আবার নতুন নিয়মে অফিসিয়ালি যে বেতনে কাজ করতে যান, তার চেয়ে বেশি টাকা পাঠাতে পারেন না কর্মীরা৷ ফলে নির্ধারিত কাজের বাইরে ‘অড জব' করে তাঁরা যে টাকা আয় করেন তা ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠাতে পারেন না৷''
তিনি বলেন, ‘‘ফর্মাল বা ব্যাংকিং সেক্টরে ডলারের রেট কম হওয়া ছাড়াও টাকাটা বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের হাতে পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই৷ সে সুযোগ বিকাশ বা অন্য কোনো ইনফর্মাল সিস্টেমে পাওয়া যায়৷ আবার ইরাক ও লিবিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকথাকলেও সেখান থেকে বৈধ পথে অর্থ পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই৷''
কিরণ জানান, ‘‘কাতারসহ আরো কয়েকটি দেশে গিয়ে শ্রমিকরা প্রতিশ্রুত বেতন পাচ্ছেন না৷ যাঁরা পাচ্ছেন তারা কোনোভাবেই বাংলাদেশে মূদ্রামানে ১০-১৫ হাজার টাকার বেশি বেতন পান না মাসে৷ ওইসব দেশে প্রতারক চক্র গড়ে উঠেছে, যারা বাংলাদেশি শ্রমিকদের ঠকায়৷''
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা দেখেছি গত এক বছরে টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হারে ব্যাংকিং এবং ইনফরমাল সেক্টরে ব্যাপক পার্থক্য ছিল৷ প্রতি ডলারে ইনফর্মাল সেক্টরে ৭-৮ টাকা বেশি পাওয়া গেছে৷ এই ব্যাপক তফাতের কারণে আন- অফিসিয়াল চ্যানেলে অনেক রেমিটেন্স বাংলাদেশে এসেছে বলে বলা হয়ে থাকে৷ ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আসা কমেছে৷ এটা উদ্বেগজনক৷ কারণ, অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ফরমাল চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়া দরকার৷ এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যক্তির কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করায় যেহেতু নানা বিধিনিষেধ আছে, তাই শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অনেক বিনিয়োগকারী বিদেশেই তহবিল সংগ্রহ করছে৷ তাঁরা সেখানেই প্রবাসীদের আয় নিয়ে নিচ্ছেন৷ হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পরিশোধ করছেন৷''
ড. নাজনীন বলেন, ‘‘এভাবে চলতে থাকলে ইনফরমাল ইকোনমি বড় হয়ে যাবে৷ ফলে অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ ঠিকঠাক থাকবে না৷ তা অর্থনীতির জন্য শেষ বিচারে ক্ষতির কারণই হবে৷''
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরন বলেন, ‘‘ব্যাংকিং চ্যানেলে যাতে প্রবাসীরা টাকা-পঠান, সেজন্য সরকারকে প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে৷ ডলারের বিনিময়হার গ্রহণযোগ্য করতে হবে৷ আর বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর দিকে মনযোগী হতে হবে৷ সংখ্যার চেয়ে দক্ষ শ্রমিকের ওপর জোর দিতে হবে৷''
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘‘বাংলাদেশের ১ কোটি প্রবাসী বছরে পাঠান ১৫ বিলিয়ন ডলার৷ আর ফিলিপাইন্সের ৩৫ লাখ প্রবাসী বছরে পাঠান ২৫ বিলিয়ন ডলার৷ এখানেই দক্ষ শ্রমিকের গুরুত্ব স্পষ্ট৷''