সমকামী বনাম বিষমকামী
২৮ অক্টোবর ২০১৫এটা পলিটিক্যাল করেক্টনেসের যুগ৷ আজ আর ঠিক-ভুল বলে কিছু নেই, আছে শুধু কোন বাজারে কোন কথা চলে কিংবা চলে না৷ কিন্তু আমি যে বয়সে পৌঁছেছি, সে বয়সে কিছু কিছু নিজস্ব ওপিনিয়ন বা মতামত তৈরি হয়ে যায় বৈকি, তা কেউ লাইক দিক আর না-ই দিক – সাকারবার্গের কৃপায় নাকি এবার আনলাইক-ও করা যাবে৷
আমার কাছে সমকামিতার যে স্মৃতি, কিশোর বয়সের সেই পর্বটাকে ইংরেজিতে বলে ‘হোমোইরোটিক ফেজ'৷ মানে সেই বয়স, যে বয়সে ছেলে স্কুলের বন্দিরা ক্লাসের কোনো এক নওলকিশোরের প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খায়! অদ্ভুত দেহহীন প্রেম৷ অথচ তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতের মঞ্জরি, আমের মঞ্জরি...৷
ভারতের মতো দেশে আমাদের আমলে সমকামীরা মোটামুটি – সামাজিক বিচারে – অদৃশ্যই থাকতেন৷ কাজেই –আজকে যে শব্দটি ব্যবহার করতেও লজ্জা হয় – ‘সত্যিকারের' সমকামীদের প্রথম দেখি, তাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় সুদূর ইউরোপে এসে৷ প্রথমজন ছিলেন এক অসাধারণ স্টাইলিশ গাড়ি বিক্রেতা৷ দ্বিতীয়জন এক হুইস্কি পিনেওয়ালা আইরিশ সাংবাদিক; তৃতীয়জন এক অসাধারণ হেয়ার স্টাইলিস্ট, আমার গিন্নি আর দুই মেয়ে যার ভক্ত ছিলেন৷
আইরিশ সাংবাদিক ভদ্রলোক আমাকে এক ‘কামিং আউট' সমকামীর আত্মজীবনী পড়তে দিয়েছিলেন – সে এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা৷ ফটোগ্রাফিতে যেমন পজিটিভ নেগেটিভ হয়; আয়নায় যেমন ডানদিক বাঁদিক গোলমাল হয়ে যায়৷ সমকামী লেখকটির আত্মজীবনী যেন আমার আত্মজীবনী হতে পারত – শুধু তাঁর মন আর চোখ যেত – ছোটবেলা থেকেই – কিশোরীদের দিকে না গিয়ে কিশোরদের দিকে৷ অর্থাৎ আমাদের সেই হোমোইরোটিক ফেজের এক্সটেনশন৷ নয়ত আবেগ-অনুভূতি কিংবা নান্দনিক বিচারে এই সমকামী আমার মতো যে কোনো বিষমকামীর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতেন – যদিও বস্তুত তাঁর কিংবা আমার পাল্লা দেওয়ার কোনো কারণ কিংবা মনোবৃত্তি কোনোকালেই ছিল না৷
দ্বিতীয়ত, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ, বিংশ শতাব্দীর সূচনা – এই সময়টায় দেখলাম বহু লেখক ও মনীষী ছিলেন সমকামী, যেমন অস্কার ওয়াইল্ড, ই এম ফর্স্টার কিংবা টি ই লরেন্স, আপনাদের লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া৷ ‘এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া' খ্যাত ফর্স্টারের কাছ থেকে শিখলাম যে, বিষমকামীরা নারী-পুরুষের সম্পর্কে যতটা স্বাধীনতা এনেছেন এবং অর্জন করেছেন, তার কয়েক দশক আগেই সমকামীরা সমাজের চোখের সামনেই – কিন্তু কোনো ম্যাজিকে অদৃশ্য থেকে – পরস্পরের হাতে হাত রেখে ঘুরেছেন, পার্কের বেঞ্চে একে অপরের কোলে মাথা রেখেছেন৷
ফিরে যাওয়া যাক রেনেসাঁসের যুগে: মিকেলআঞ্জেলো কিংবা দা ভিঞ্চির মতো মহান শিল্পীরাও ছিলেন সমকামী৷ ধীরে ধীরে বুঝলাম, মানব সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সমকামীদের অবদান বিশাল, তারা সামাজিক প্রগতির বহুক্ষেত্রেই পথিকৃৎ৷ শুধু একটি দিক ছাড়া: প্রকৃতি ও বায়োলজি যে প্রক্রিয়ায় শুধু মানুষ নয়, সব জীবের বংশবিস্তারের ব্যবস্থা করেছে, অর্থাৎ খোদ এভোলিউশন বা বিবর্তন যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই সন্তানের জন্মদানের ক্ষেত্রে সমকামিতার কিছু বলার কিংবা করার নেই৷
অবশ্যই সমকামীরা সন্তান প্রতিপালন করতে পারেন৷ কিন্তু নারী-পুরুষের মিলনের মধ্যে যে অনন্ত যাত্রার বীজ প্রোথিত আছে, রোপিত আছে, তাকে অশ্রদ্ধা করাও উচিত হবে না৷ সহানুভূতিশীল সমকামীরা নিজেরাই সর্বাগ্রে তা স্বীকার করবেন৷ বিপদটা তাহলে কোথায়?
বিপদটা হলো: কোনো কারণে মানুষ আর মানুষের মধ্যে তারতম্য করা৷ বিষমকামীদেরই ধরা যাক: তাহলে কি সন্তানহীন দম্পতিদের মূল্য, অবস্থান কিংবা মর্যাদা সন্তান সম্পন্ন দম্পতিদের চেয়ে কম? আর যাঁরা বিবাহই করেননি, তাঁরা? জীবজগতে সাথি খোঁজার সাফল্য কিংবা প্রজনন সাফল্য সকলের কপালে জোটে না, বাঘভাল্লুক, মানুষ কিবা উচ্চিংড়ে, কারোরই নয়৷ কাজেই সেই প্রজননের উদ্দেশ্য কিংবা প্রজননের সাফল্য থেকেই মানুষ আর মানুষের মধ্যে সম্পর্কের যাবতীয় মাধুর্য, প্রয়োজনীয়তা কিংবা গুরুত্বের মূল্যায়ন করাটা কি উচিত?
ওদিকে গিন্নি বলছিলেন, নাতি হতে চলেছে, এখন অন্তত তাত্ত্বিক কচকচি ছেড়ে মেয়েটাকে...
ব্লগটিতে আপনি কি কিছু যোগ করতে চান? তাহলে লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷