টাইটানিক তোলার প্রচেষ্টা
১২ জুন ২০১২পাক্বা ১০০ বছর আগের কথা৷ সেই এক শতাব্দ আগের এই গ্রহের সবচেয়ে মূল্যবান প্রমোদতরী সমুদ্রে ভাসল৷ শয়ে শয়ে মানুষ তাতে উঠে পড়লেন৷ বিভিন্ন দেশ থেকে যাত্রী সংগ্রহ করে নিয়ে অতলান্তিক সমুদ্রের অগাধ জলে একদিন গভীর রাতে সেই দৈত্যাকার জাহাজ হিমশৈলের ধাক্কা খেল৷ তারপর তলিয়ে গেল অকূল সমুদ্রে৷ গত শতকেরই নয়ের দশকে জেমস ক্যামেরনের ব্লকবাস্টার টাইটানিক ছায়াছবির কল্যাণে গোটা বিশ্বের কারওই আর এসব তথ্য জানতে বাকি নেই৷ কিন্তু, এই যে রোম্যান্টিক জাহাজখানা, যে কিনা সমুদ্রের নীচে রয়ে গেছে, তাকে এবার তুলে আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছে৷ অতলান্তিক সমুদ্রের নীচে পড়ে থাকা এই জাহাজকে প্রথম যিনি আবিষ্কার করেন, সেই নামজাদা ডুবুরি রবার্ট ব্যালাড বলছেন, গুপ্তধনের জন্য নয়৷ টাইটানিককে স্রেফ সুরক্ষিতভাবে রক্ষা করা হোক৷
টাইটানিকের সুরক্ষাই তো শুধু নয়, এর সঙ্গে বেশ ভালো করেই জড়িয়ে গেল আধুনিক বিজ্ঞানের দায়দায়িত্বও৷ সমুদ্রের নীচে তলিয়ে যাওয়া এরকম কত ঐশ্বর্য আর কত ইতিহাস যে রয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই৷ শতাব্দের পর শতাব্দ ধরে মানবজাতি একদেশ থেকে অন্যদেশে সবসময়েই গেছে সমুদ্রপথে৷ রতনভরা কত বাণিজ্যতরী, কতশত জলদস্যুদের তরণী কিংবা সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়া কত অসহায় নাবিকদের জাহাজ এভাবেই ডুবে গেছে সমুদ্রে৷ তাদের অনেকেই আজও সেই অবিকৃত চেহারায় শুয়ে রয়েছে গভীর সমুদ্রে৷ শুধু তো সেই জাহাজগুলোই নয়, সমুদ্রের নীচে, নীল জলের বাতাবরণে থমকে রয়েছে সময়, থমকে রয়েছে ইতিহাস৷ আটকে রয়েছে মহাকালের স্পর্শ৷ যার দিকে খোলা চোখে তাকালে অবশ্যই সেই সময়টাকে ধরা যাবে৷
টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর থেকে তাকে খুঁজে বের করার জন্য বিস্তর চেষ্টা চরিত্র হয়েছে৷ কারণ, যেহেতু এই জাহাজের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক গল্প, রহস্য আর অনেক মর্মন্তুদ কাহিনি, সুতরাং এই জাহাজটি সমুদ্রে নীচে ঠিক কোথায় রয়েছে, তা জানতে আগ্রহ ছিল গোটা বিশ্বের৷
টাইটানিকের সেই অতীতকে প্রথম খুঁজে বের করেছিলেন যিনি, তিনিই হলেন রবার্ট ব্যালাড৷ সময়টা ১৯৮৫৷ নামজাদা সমুদ্রবিদ ব্যালাডের আগে যে বা যারা টাইটানিকের খোঁজ করেছিলেন, সকলেই গভীর জলে খোঁজাখুঁজি করেন৷ কিন্তু সেখানে তো নেই টাইটানিক৷ যেহেতু তার আকৃতিটা বিশাল, তাই সকলেরই ধারণা হয়েছিল, টাইটানিক নিশ্চয়ই অনেক গভীর জলেই ডুবেছে৷ কিন্তু আসল ঘটনা হয়েছিল অন্য৷ সমুদ্রের মাত্র ৩৮০০ মিটার নীচে ছিল টাইটানিক৷ আর ব্যালাডই প্রথম জীবিত মানুষ যিনি টাইটানিকের সেই ৭৩ বছরের অহল্যার অপেক্ষার শেষ করেন৷ সমুদ্রতলের নীলাভ আলোয় প্রথমবার সেই বিখ্যাত জাহাজকে দেখে এসে তিনি জানান তার খবর গোটা বিশ্বকে৷
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল বললে ভুল বলা হবে না৷ সম্প্রতি রবার্ট ব্যালাডকের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছে জার্মান সংবাদসংস্থা ডিপিএ৷ যেখানে ব্যালাড জানিয়েছেন টাইটানিককে প্রথমবার দেখার পরে তাঁর অভিজ্ঞতা আর সেই মানসিকতার পরিবর্তনের কথা৷ ব্যাপারটা হয়েছিল এরকম, ব্যালাড বলছেন, আসলে টাইটানিককে প্রথম খুঁজে বের করে কোন মানুষ নয়৷ একটি ডুবুরি রোবোট৷ তার কিছুদিন পরে রোবোটের দেওয়া তথ্য অনুসরণ করে ডুবোজাহাজ বা সাবমেরিনে চড়ে তিনি স্বয়ং যান সমুদ্রের নীচে৷ টাইটানিকের ঠিকানায় পৌঁছে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে তাঁর কষ্ট হয়েছিল৷ স্বভাবতই এ এক মস্তবড় আবিষ্কার৷ তারপরে যে ভাবনাটা সকলের মনে চাড়িয়ে যায় যে এই জাহাজ তো আসলে সাড়ে তিনশোর বেশি মানুষের সলিল সমাধি৷ তাঁদের কবরের ওপর এই উল্লাসনৃত্য এক ধরণের অপমান তো তাদের জন্য৷
সুতরাং এরপর থেকে বদলে যায় আবিষ্কর্তা থেকে অন্য সকলের মানসিকতা৷ তাই তাঁদের দাবি, টাইটানিককে যদি অতল জলের তলা থেকে তোলাও হয়, তবে সে কাজটা হবে শ্রদ্ধার সঙ্গে৷ লুঠপাট করতে নয়৷ সে কাজ হবে শ্রদ্ধা জানাতে৷
বিজ্ঞানের অবদান অনেক সময়ে মানুষের আবেগের সামনে এসে থমকে যায় যে, তার প্রমাণ আবারও মিলল এই টাইটানিক কাণ্ডে৷ যেমন, টাইটানিকের আবিষ্কর্তা রবার্ট ব্যালাড বলছেন, ‘আমার মত নেওয়া হলে বলব, থাক ওই জাহাজ যেখানে আছে, সেখানেই৷ মাটির ওপরে তুলে আনলে রহস্যটাও তো সেইসঙ্গে হারিয়ে যাবে৷'
আর কে না জানে, রহস্যই হল যাবতীয় রোমান্সের আসল চাবিকাঠি৷ তাই, বিজ্ঞান বলছে বলুক, রোমান্সটা যেন হারিয়ে না যায়৷
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় (ডিপিএ)
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন