সুন্দরবনে ত্রাণের সঙ্গে প্লাস্টিক দূষণ
১৯ জুন ২০২০আমফানে বিধ্বস্ত গ্রামবাংলার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শহর-মফস্বল৷ এত ব্যাপক হারে ত্রাণ, সাহায্যের উদ্যোগ অতীতে কখনও দেখা যায়নি৷ প্রায় প্রতিদিনই সমাজকর্মীদের ছোট ছোট দল শুকনো খাবার, জল, ওষুধ, ত্রিপল, জামাকাপড়, সৌরআলো পৌঁছে দিতে যাচ্ছে দুই ২৪ পরগণা এবং এখন বিশেষত সুন্দরবন অঞ্চলে৷ এইসব ত্রাণসামগ্রী যাচ্ছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে৷ যাঁরা ত্রাণ পৌঁছতে যাচ্ছেন, তাঁরাও বিস্কুট, চিপস, বাদামের মতো শুকনো খাবার, জলের বোতল নিয়ে যাচ্ছেন নিজেরা সারাদিন খাবেন বলে৷ এবং তার খালি প্যাকেট, বোতল এবং নানা মাপের প্লাস্টিকের ব্যাগ তাঁরা দিনের শেষে ফেলে রেখে আসছেন ওই সব অঞ্চলে৷ স্থানীয় বাসিন্দারাও দরকারি জিনিসটি বের করে নিয়ে প্লাস্টিক ফেলে দিচ্ছেন৷ ফলে জমছে প্লাস্টিকের পাহাড়, বাড়ছে দূষণ৷
কলকাতার ইএনটি চিকিৎসক ডাঃ কল্লোল দাস, পর্বতারোহী, অভিযাত্রী, বেলুড়ের বাসিন্দা অনিন্দ্য মুখার্জি সাহায্য পৌঁছতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের হিঙ্গলগঞ্জ এলাকায়৷ মূলত খাবারদাবার এবং ওষুধপত্র দিতে৷ সেখানে কনকনগর সৃষ্টিধর ইন্সটিটিউশনের প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী তাঁর স্কুলের এক দল সাবেক ছাত্র, কয়েকজন সহমর্মী শিক্ষক ও অভিভাবককে সঙ্গে নিয়ে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকার পুনরুজ্জীবনে যে কাজ চালাচ্ছেন, তা দেখে ওঁরা উৎসাহিত হন এবং একজোটে কাজ করার ইচ্ছে জানান৷ এলাকায় একটি স্বাস্থ্য শিবির করার জন্য কিছুদিন পরই ওঁরা আবার ওই অঞ্চলে ফিরে যান৷ নদীতীরবর্তী এলাকায় প্লাস্টিকের স্তূপ জমে ওঠার সমস্যাটা তখনই ওঁদের সবার নজরে পড়ে৷
ডাঃ কল্লোল দাস জানাচ্ছেন, ‘‘আমরা যখন গেলাম, তখন দেখলাম, শুধু ত্রাণের প্লাস্টিক নয়, স্থানীয় লোকেরাও প্রচুর (প্লাস্টিক) ফেলছে৷ তাদের মধ্যে অনেকে অবশ্য বলল, যে আমাদের খুব খারাপ লাগছে, আপনারা এভাবে পরিষ্কার করছেন৷ এবং মাস্টারমশাই নিজেও পরিষ্কার করছেন৷ হেড মাস্টারমশাই স্কুলের, তিনি ওখানে মাটি থেকে প্লাস্টিক তুলছেন৷ কলকাতা থেকে আমাদের টিম গিয়ে প্লাস্টিক তুলছে৷ তো এটা একটি সত্যিই দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যাপার, যে স্থানীয় লোকেদের যদি কিছু (সচেতনতা) হয় আর কী! কিন্তু এটা একটা অনগোয়িং প্রসেস৷ এটা করতে হবে বার বার করে৷ এই সময়গুলোতে না, লোকের অ্যাটেনশন অন্য দিকে থাকে৷ স্বাভাবিক ব্যাপার, যে লোকে চাল-ডাল নেবে, নাকি প্লাস্টিক জড়ো করবে!’’
অনিন্দ্য মুখার্জি প্রতি বছরই উৎসাহীদের নিয়ে পর্বতারোহণে যান৷ তাঁর প্রতিটি যাত্রায় তিনি হিমালয়ের পথে অন্যান্য অভিযাত্রীদের ফেলে আসা প্লাস্টিক, ক্যান, ইত্যাদি বর্জ্য যতটা পারেন সমতলে ফেরত নিয়ে আসেন৷ সুন্দরবন অঞ্চল ঘুরে আসার পর তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘ত্রাণ দিতে গিয়ে এটা একটা বড় সমস্যা তৈরি হয়ে গেছে৷ যেটা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম এবং দেখে মনে হয়েছিল, ইমিডিয়েটলি এটা (পরিষ্কার) করা দরকার৷ এখন অবধি সবার নজর আছে ওই দিকে, অন্য সময় তো সবার খেয়াল থাকে না৷ তো এখনই, বর্ষা আসার আগে কিছু কাজ এগিয়ে রাখার কথা ভেবেছিলাম৷ এমনিতেই ম্যানগ্রোভের মর্ফো-ডায়নামিক্সে প্লাস্টিক একটা ভয়ংকর সমস্যা৷ সুন্দরবনের পটভূমিকায়৷ সেইখানে হঠাৎ মনে করুন টন টন এক্সট্রা প্লাস্টিক গিয়ে পড়া৷’’
কাজেই শুরু হয়েছে হিঙ্গলগঞ্জের এক বড় এলাকা প্লাস্টিকমুক্ত করার কাজ, যে কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক পুলক রায়চৌধুরী৷ তিনি জানালেন, ঘূর্ণিঝড় আমফানের ঠিক আগের দিন স্কুলের কিছু সাবেক ছাত্রকে নিয়ে তিনি একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যাতে ঝড়ের দাপট কেটে যাওয়ার পরই এলাকার ক্ষয়ক্ষতির একটা বাস্তবিক হিসেব পাওয়া যায়৷ একই সঙ্গে ওই অঞ্চলের বাসিন্দা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারের একটি তথ্যপঞ্জি তৈরি করেছিলেন তাঁরা৷ প্রতি পরিবারের সদস্য সংখ্যা, মহিলা ও শিশুর সংখ্যা, বয়স্ক সদস্য কজন, পরিবারে কোনো মহিলা গর্ভবতী কি না, কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী আছেন কি না— সব তথ্য জোগাড় করা হয়েছিল৷ এলাকায় জমে ওঠা প্লাস্টিকের পরিমাণ নিশ্চিত করতে একইভাবে তাঁরা একটি তথ্যপঞ্জি তৈরি করেছেন৷ তার ভিত্তিতেই কোথা থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হবে, কীভাবে সেগুলো আলাদা করা হবে, সেসব আলোচনার ভিত্তিতে ঠিক হলো৷ বাইরে থেকে যাওয়া প্রায় ২০ জন স্বেচ্ছাসেবক, স্কুলেরও প্রায় ২০ জনের দলের সঙ্গে স্থানীয় সাফাইকর্মীদেরও যুক্ত করে নেওয়া হলো৷ এবং মাত্র দুদিনের সাফাই অভিযানে মজুত হলো ২৮ বস্তা প্লাস্টিক, যার মধ্যে ১৪ বস্তা স্রেফ খালি জলের বোতল৷
এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের হাত থেকে পরিবেশকে মুক্তি দিতে কী ভাবা হয়েছে, সেটা জানালেন পুলকবাবু৷ বললেন, ‘‘এটা রিসাইক্লিং করেন যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে আমাদের একটা (কথা হয়েছে).. মানে দুতিনটে সংস্থা রয়েছে৷ ধাপার একটা সংস্থা রয়েছে৷ এবং শিপ্রা মুখার্জি, বারাসাত স্টেট ইউনিভার্সিটির হেড অফ দ্য ডিপার্টমেন্ট, ইংলিশ, উনিও এ ব্যাপারে যোগাযোগ করছেন৷ ওনার একটা পরিচিতি আছে, যাঁর মাধ্যমে আমরা এই জায়গাতে যে ব্যাগগুলো জমা হয়েছে, ওইগুলো, ওই সংস্থার সঙ্গে একটা দীর্ঘস্থায়ী টাই আপ করব, যাতে করে এটাকে ডাম্পিং না করে, মাটির তলায় না দেয়, যাতে এটা প্রপারলি রিসাইকেল্ড হয়৷’’
কাজেই শুরু হয়েছে এক কর্মযজ্ঞ৷ শহুরে বেখেয়ালে গ্রামাঞ্চলে ফেলে আসা প্লাস্টিক আবার ফেরত এনে রিসাইকেল করা, অর্থাৎ পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলা৷ এবং ওঁরা বলছেন, এই প্রক্রিয়া চালু থাকবে আগামী কয়েক বছর৷ তবে এর মধ্যেই স্থানীয় মানুষজনকে এই কাজে যুক্ত করার চেষ্টায় সুফল পাওয়া গেছে৷ সচেতনতা বাড়ছে সেই সুবাদে৷ ‘‘ওখানকার মানুষজনের যখন বক্তব্য নিচ্ছিলাম আমরা, রেকর্ড করছিলাম, তার মধ্যে কয়েকজন বলেছেন, স্যার, আমরা লজ্জিত৷ আমাদের লজ্জা লাগছে যে আপনারা এটা পরিষ্কার করছেন,’’ জানালেন পুলক রায়চৌধুরী৷ তিনি মনে করছেন, গোষ্ঠী অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার কাজটায় তাঁরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পারলেন এভাবে৷ এবং ডাঃ কল্লোল দাস, অনিন্দ্য মুখার্জি জানিয়েছেন, ওঁরা এই সমবেত উদ্যোগে হিঙ্গলগঞ্জে পরিবেশ সুরক্ষার একটা মডেল গড়ে তুলতে চান, যা বাকিরা অনুসরণ করবে৷ এখন লক্ষ্য সেটাই৷