অনলাইন থেকে ছড়াচ্ছে বিপদ
১৭ নভেম্বর ২০১৮মিয়ানমারের এক বৌদ্ধ মহিলা তাঁর সাথে হওয়া ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করতে থানায় যান৷ তিনি বলেন যে স্থানীয় দুই মুসলমান ব্যক্তিদের দ্বারা নিগৃহীত হন তিনি৷ কিছুদিন পর আরেক সন্ন্যাসী যখন এই বিষয়টি ফেসবুকে একটি পোস্টে বিস্তারিত তুলে ধরেন, নতুন করে শুরু হয় অশান্তি৷
এই পোস্টের কারণে পার্শ্ববর্তী মান্ডালে অঞ্চলে সংখ্যাগুরু গোষ্ঠীর মধ্যে টানা দু'দিন ধরে চলে হিংসা৷ সংঘর্ষে দু'জন মারা যান ও ১৯ জন আহত হন৷ সেই অঞ্চলে ফেসবুক কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করা হলে তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে৷
তদন্ত শেষ হলে জানা যায়, মুসলমানেদের বিরুদ্ধে যে খবর রটানো হয়েছিল তা আদতে সম্পূর্ণ মিথ্যে৷ শুধু তাই নয়, ধর্ষণের অভিযোগ তোলা নারীও পরে স্বীকার করেন যে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করার জন্য টাকা নিয়েছিলেন তিনি৷
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মিথ্যা খবর ছড়ানো বিষয়ে এটি একটি ছোট্ট উদাহরণ মাত্র৷
মিয়ানমার, যে দেশ থেকে ইতিমধ্যে প্রায় ৭০০,০০০ রোহিঙ্গা মুসলমানেরা ঘরছাড়া হয়ে বাধ্য হয়েছেন অন্যদেশে পাড়ি দিতে, সেই দেশে ফেসবুকের ব্যবহার নিয়ে গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে একটি নতুন তথ্য৷ একটি বিশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, মিয়ানমারে ফেসবুকের মতো অনলাইন যোগাযোগের মাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়ানো ব্যক্তিদের একটি অংশ বাস্তবের অফলাইন দুনিয়াতেও এই কাজে লিপ্ত থাকে৷
ভুল তথ্য ও সহিংসতা
‘বিজনেস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি' সংস্থার এই রিপোর্ট দেখায় সোশ্যাল মিডিয়া কীভাবে ব্যবহৃত হয় মানুষকে বিভ্রান্ত করতে৷ এই বিভ্রান্তিই পরে হিংসার রূপ নেয়, যা এক গোষ্ঠীকে আরেক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ায়৷
কিন্তু এই সমস্যা শুধু মিয়ানমারেই সীমিত নয়৷ ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির মতো দেশেও রয়েছে এই প্রবণতা৷
জার্মানির ডানপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি)-র শরণার্থীবিদ্বেষী ফেসবুক পোস্ট করার হারের সাথে সাথে সেখানে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শরণার্থীদের ওপর অত্যাচার৷ ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষকের কাজ থেকে জানা গেছে এই তথ্য, যা বোঝায় সামাজিক গণমাধ্যমের বাস্তবিক ক্ষমতার গণ্ডীকে৷
হিংসার সংস্কৃতি
অনলাইনে ভুল খবর ছড়ানো মানুষেরা বাস্তব জগতে এমন কাজ করেন না, তা মানতে নারাজ বেশির ভাগ গবেষক৷ সাম্প্রতিক সময়ে পাওয়া তথ্য এই প্রবণতাকেই প্রমাণ করে৷
কেউ কেউ এমনও থাকেন যারা অনলাইনের নকল দুনিয়ায় এতই গভীরভাবে ডুবে থাকেন যে ইন্টারনেট আর জীবনের মধ্যে পার্থক্য করতে ভুলে যান৷ এমনটাই মনে করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেট বিশেষজ্ঞ ভরত গণেশ৷ টুইটার ও ফেসবুকে ছড়ানো মিথ্যে খবরের ভিত্তিতেই জার্মানির কেমনিৎস শহরে ৬০০০ মানুষ অতি-ডানপন্থি মিছিলে যোগ দেয়৷ মার্কিস যুক্তরাষ্ট্রের শার্লটসভিলে শোনা গিয়েছিল এমন স্লোগান, যা সেই অঞ্চলের অতি-ডানপন্থি গোষ্ঠীগুলির ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া৷
দর্শককে বেশি সময় ধরে পর্দায় আটকে রাখতে ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো ওয়েবসাইট এক ধরনের বিশেষ অ্যালগোরিদমের সাহায্য নেয়৷ আপনি যা দেখতে চাইছেন, ঠিক তাই দেখাতে পারে এই অ্যালগোরিদম৷ কী বিষয়ে জানতে আপনি ঘন ঘন ইন্টারনেট সার্চ করছেন তা থেকে একটি প্যাটার্ন ঠিক করে নিয়ে এই অ্যালগেরিদম সৃষ্টি করবে এক ‘বাবল' বা বুদবুদের৷ এই বাবল দর্শকের কাছে একটি কাল্পনিক দুনিয়ার সমান৷
এ বিষয়ে কনরাড আডেনাওয়ার ফাউন্ডেশনের সন্ত্রাসবাদ-বিরোধ বিশেষজ্ঞ লিন্ডা শ্লেগেল বলেন, ‘‘এই বাবল থেকে ডিজিটাল যুগের সন্ত্রাসী জন্ম নিতে পারে৷ বারবার একই জিনিস দেখতে দেখতে মস্তিষ্ক তাকে সত্য বলে মেনে নেয় এক সময়৷ এভাবেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে মৌলবাদ মাথায় ঢুকে যেতে সক্ষম হয়৷''
ইউটিউবের ক্ষেত্রেও এমনই আরেক অ্যালগোরিদম কাজ করে যা বিশেষ কিছু ভিডিও-র প্রতি দর্শকের পক্ষপাতকে বুঝে নিয়ে কাছাকাছি বিষয়ের অন্যান্য ভিডিও হাতের কাছে এগিয়ে দেয়৷ ফলে প্রায়ই দেখা যায় বিশেষ কিছু ভিডিও অ্যালগোরিদমের জাদুস্পর্শ পেয়ে লক্ষাধিক মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে৷
বর্তমান সময়ে বেশি মানুষের কাছে খবর পৌঁছানো মানেই বেশি আয়৷ অনলাইন বিজ্ঞাপনের পেছনে টাকা ঢালা সংস্থাগুলি তাই ব্যস্ত কীভাবে নতুন নতুন সফটওয়্যার বা অ্যালগোরিদমের সাহায্যে বাড়ানো যায় প্রতি ভিডিও বা ফেসবুক পোস্টের নাগাল৷ খবর মিথ্যে হোক বা সত্যি, সবার গুরুত্ব তা আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটুকুই৷
সে কারণেই মিথ্যে খবর ছড়ানো নিয়ে বাড়ছে গবেষক মহল থেকে প্রশাসন সর্বত্র চিন্তার ছায়া৷
মর্গান মিকার/এসএস
আপনার কী মনে হয় বন্ধু? অনলাইন থেকে অফলাইনে কি সত্যিই ছড়াতে পারে বিপদ? লিখুন নীচের ঘরে৷