অস্কার পুরস্কার
১ মার্চ ২০১২তেরো বছরের জাকিয়া৷ শিক্ষক তাকে শারীরিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তাব দেয়৷ এ প্রস্তাব গ্রহণ করেনি সে৷ প্রস্তাব তিরস্কৃত হবার পর খেপে ওঠে বালিকার শিক্ষক৷ ক্রোধান্বিত হয়ে ফুটফুটে কিশোরীর মুখে একদিন ছুঁড়ে দেয় অ্যাসিড৷
জাকিয়ার মতো এমন আরো হাজারো মেয়ে অ্যাসিডের স্বীকার হচ্ছে পাকিস্তানের প্রদেশে প্রদেশে৷ হয় স্বামী, নয় এলাকার বখাটে তরুণ, নয় প্রেমে সাড়া না পাওয়া পুরুষ কিংবা পারিবারিক রেষারেষির জের ধরে মেয়েদের ওপরে ছোঁড়া হচ্ছে অ্যাসিড৷
অ্যাসিডাক্রান্ত নারীদের সে কথাগুলো নিয়েই ‘সেভিং ফেস' নামে প্রামাণ্য চিত্র বানিয়েছেন শারমিন ওবায়েদ চিনয়৷ আর এই ছবিটিই পাকিস্তানকে এনে দিলো অস্কার অর্জনের সম্মান৷
প্রথম বারের মতো পাকিস্তানে এসেছে অস্কার৷ আনন্দটা তাই বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো ছড়িয়ে গেছে সারা দেশে৷ সেই উচ্ছ্বাসেরই খানিকটা উঠে এসেছে করাচির সাংবাদিক মোহসিন সাঈদ'এর স্বরে৷ সাঈদ বলছেন, ‘‘আমি সত্যি বিস্মিত, অবাক, আনন্দে বিমুঢ়৷ আমার কাছে ঘটনাটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে৷ মনে হচ্ছে যেনো একটা ঘোর৷''
‘সেভিং ফেস' নামের ছোট্ট এই প্রামাণ্য চিত্রে চিনয় প্রধানত তুলে ধরেছেন জাকিয়া ও রোকসানা নামের দুই নারীর গল্প৷ আর এই দুই নারীর বাস্তবতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন পুরো পাকিস্তানের অ্যাসিড সন্ত্রাসের ভয়াবহতার ছবি৷
‘সেভিং ফেস' প্রামাণ্য চিত্রটিতে আছে আরেকজন ডাক্তারের কথা৷ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সার্জন মোহাম্মদ জাওয়াদ ব্রিটেন ছেড়ে এসেছেন পাকিস্তানে৷ উদ্দেশ্য, নিজের দেশের অ্যাসিড আক্রান্ত নারীদের সহায়তা করা৷
পাকিস্তানের অ্যাসিড আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করে ‘স্মাইল এগেইন ফাউন্ডেশান'৷ ‘সেভিং ফেস' প্রামাণ্য চিত্রটি বানানোর সময় তাতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন এই সংস্থার প্রধান মুসরাত মিসবাহ৷
‘সেভিং ফেস' অস্কার পাবার পর মিসবাহ নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘‘এই খবরটা যেই শুনছে সেই ভীষন খুশি৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘অ্যাসিড ইস্যুটা এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেছে৷ এই অ্যাসিড সন্ত্রাস বন্ধ করার জন্য আমাদের সরকার এবং সমাজের ওপরে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে একটা চাপ প্রয়োগ করা যাবে৷ এটি আমাদের জন্য একটি খুবই ইতিবাচক ব্যাপার৷'' এছাড়া, জনগন এখন এই বিষটি নিয়ে আরো বেশি সচেতন হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি৷
সাংবাদিক মোহসিন সাঈদ বলছেন, পাকিস্তানে সিনেমা শিল্প এখন মৃতপ্রায়৷ সেই মৃতপ্রায় শিল্পের দেশের মেয়ে হয়ে চিনয়ের অস্কার বিজয় একটা বিরাট আশাবাদ৷ তিনি আরো বলেন, ‘‘চিনয়, অ্যাসিড ইস্যুটিকে এতো চমৎকারভাবে তুলে ধরেছে যে, এটি সারা দুনিয়ার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে৷''
তবে শুধু অ্যাসিড নয়, পতিতাবৃত্তি থেকে শুরু করে পাকিস্তানের বিভিন্ন সমস্যাকেও বিভিন্ন সময়ে প্রামাণ্য চিত্রে তুলে এনেছেন চিনয়৷
‘পাকিস্তানস তালেবান জেনারেশন' বা ‘পাকিস্তানের তালেবান প্রজন্ম' নামে একটি প্রামাণ্য চিত্রের জন্য ২০১০ সালে চিনয় আন্তর্জাতিক এমি পুরস্কার অর্জন করেন৷ আর এবারে অস্কার অর্জনের পর সে দেশের মানুষ খুশিতে আত্মহারা৷ ‘সেভিং ফেস' প্রামাণ্য চিত্রটিতে চিনয়ের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন অ্যামেরিকান নাগরিক ড্যানিয়েল জাঙ্গে৷
শারমিন ওবায়েদ চিনয়ের জন্ম ১৯৭৮ সালে, করাচিতে৷ তারপর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজ ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে৷
সাধারণ নাগরিক থেকে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিবিদ সবাই বলছেন, শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতা, বোমাবাজি বা ধর্মীয় জঙ্গিবাদের খবর নয়, দুনিয়ার মানুষের কাছে পাকিস্তান এবারে একটি ইতিবাচক খবর হলো৷ তাদের জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
প্রতিবেদন: আফরোজা সোমা
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক