1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আদর্শ প্রকাশনীর জন্য এক শর্ত, বাংলা একাডেমির জন্য পাঁচ

২০ জানুয়ারি ২০২৩

২০১৯ সালের মতো এবারের আসন্ন অমর একুশে বই মেলাতেও স্টল পাওয়া নিয়ে জটিলতার মুখে আদর্শ প্রকাশনী৷ একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একটি শর্ত মানলেই স্টল পাবে আদর্শ৷ তবে প্রকাশনীটি পাল্টা পাঁচটি শর্ত রেখেছে বাংলা একাডেমির সামনে৷

https://p.dw.com/p/4MVUV
বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টল
বইমেলায় আদর্শ প্রকাশনীর স্টল (ফাইল ছবি)ছবি: Privat

যেসব বই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে সেগুলো রাখা যাবে না- পরোক্ষভাবে এমন শর্ত দিয়েছে বাংলা একাডেমি৷

আদর্শ প্রকাশনীর কর্ণধাররা বলছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষিদ্ধ না করলে সেই বই স্টলে রাখতে বাধা দিতে পারে না বাংলা একাডেমি৷ যদি এমন সিদ্ধান্ত আসে, তাহলে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন৷ তারা বলছেন, যে বইগুলো প্রকাশ করা হয়েছে, সেগুলো জেনে-বুঝেই প্রকাশ করা হয়েছে৷

সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তাদের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি- সেটা ঠিক না৷ তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে৷ তবে বাংলা একাডেমির নীতিমালা মেনে তাদের চলতে হবে৷’’

আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুব রাহমান শুক্রবার বিকেলে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘সর্বশেষ যে স্টল বরাদ্দের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে আমাদের নাম নেই৷ কেন নেই সে কথা একাডেমির কেউ আমাদের বলেননি৷ নতুনভাবে যদি বরাদ্দ দেওয়া হয়েও থাকে তা আমরা জানি না৷ আমাদেরকে চিঠি দিয়ে বাংলা একাডেমি এখন পর্যন্ত কিছু জানায়নি৷’’

স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়নি সেটা ঠিক না, বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে: সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী

তবে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে শুক্রবারও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন কোনো তালিকা বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেনি৷ যেটি টাঙানো আছে সেটি গত ১২ জানুয়ারিতে প্রকাশ করা৷ ওই স্টল বরাদ্দের তালিকায় আদর্শ প্রকাশনীর নাম নেই৷

বাংলা একাডেমির সচিব এ এইচ এম লোকমান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘তাদের কিছু বই নিয়ে বিতর্ক উঠেছে৷ সেই বইগুলো তারা রাখতে পারবে না, এই শর্তে তাদের স্টল বরাদ্দ দেওয়া হবে৷ তারা বড় প্রকাশনী৷ তাদের স্টল না দেওয়ার কোনো কারণ নেই৷ শিগগিরই এ ব্যাপারে তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে৷ নীতিমালা তো সবাইকে মানতে হবে৷’’

যে বইগুলো নিয়ে বিতর্ক

আদর্শ প্রকাশনীর স্টল বরাদ্দ না পাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে আলোচনা৷ অনেকে বাংলা একাডেমির এ সিদ্ধান্তের সমালোনা করছেন৷ গত মঙ্গলবার দুই লেখক ফেসবুকে দাবি করেন, তাদের বইয়ের কারণে আদর্শকে স্টল বরাদ্দ দিচ্ছে না বাংলা একাডেমি৷ তাদের একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত ফাহাম আব্দুস সালাম৷ তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বড় মেয়ে শামারুহ মির্জার স্বামী৷ আদর্শ থেকে প্রকাশিত তার বইয়ের নাম ‘বাঙালির মিডিয়োক্রিটির সন্ধানে’৷ অপর বইটি হলো ‘অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা’৷ এটি লিখেছেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব৷ তিনি দেশের জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লেখেন৷ দেশের বাইরে টেকসই উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি৷

আদর্শ প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহাবুব রাহমান বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নেতৃবৃন্দের বরাত দিয়ে জানান, এ দুটির সঙ্গে আরো একটি বই নিয়ে আপত্তি আছে বাংলা একাডেমির৷ অ্যাকটিভিস্ট ও বিশ্লেষক জিয়া হাসানের লেখা ওই বইয়ের নাম ‘উন্নয়ন বিভ্রম’৷ এ তিন লেখক সামাজিক মাধ্যমে সরকার-বিরোধী হিসেবে পরিচিত৷ ফেসবুকে তারা নিয়মিত আলোচনায় থাকেন৷ বাংলা একাডেমি বলছে, পুলিশের পক্ষে থেকেও এই বইয়ের ব্যাপারে আপত্তি দেওয়া হয়েছে৷

আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত তিনটি বই৷
যে তিনটি বই নিয়ে বিতর্ক আছে বলে অভিযোগ বাংলা একাডেমিরছবি: Privat

ফাহাম আব্দুস সালাম এবং ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ফেসবুকে লিখেছেন, তাদের বই তুলে নিয়ে আদর্শকে যেন বইমেলায় স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়৷ তবে মাহাবুব রাহমান বলেছেন, ‘‘এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই৷ আমি বইগুলো ওন করি৷’’

এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজনীতি নিয়ে বই লিখলে বিতর্ক হবেই৷ কোনো রাজনৈতিক দল সেই বই পড়ে খুশি হবে, কোনো দল নাখোশ হবে৷ শুধু এই বিতর্কের কারণে কোনো প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দেওয়া খুবই অযৌক্তিক৷ আমি মনে করি, বাংলা একাডেমি এ ব্যাপারে দ্রুতই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে৷’’

প্যাভিলিয়ন বরাদ্দসহ  দাবি আদর্শ প্রকাশনীর

অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৩ এ প্রাপ্যতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী নিজেদের জন্য প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ চেয়েছে আদর্শ প্রকাশনী৷ আদর্শ প্রকাশনী বলছে, বাংলা একাডেমি প্রতি বছরই বিভিন্ন অজুহাতে বিভিন্ন প্রকাশনীকে হয়রানি করে৷ ‘‘২০১৯ সালেও যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল তা অমূলক প্রমাণ করে আদর্শ স্টল পেয়েছিল৷ পরিস্থিতি যা-ই হোক, লেখকদের বই প্রকাশে, বিক্রিতে এবং পাঠকদের বই পেতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় আমরা তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো,’’ বলেন মাহাবুব রাহমান৷

মেলা কমিটির সচিব ফোনে বলেন, আদর্শর বইতে সরকারবিরোধী মত রয়েছে: আদর্শ প্রকাশনীর সিইও

মাহাবুব রাহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনার কারণে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে৷ এছাড়া কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে ক্ষতির পরিমাণ আরো বেড়েছে৷ এ অবস্থায় অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে ঋণ করে আদর্শ অর্থ বিনিয়োগ করেছে৷ অনেকগুলো বই প্রেসে আটকে আছে, অনেকগুলো বই বাঁধাইখানায় আটকে আছে৷ গত ১২ জানুয়ারি বিকেলে বাংলা একাডেমি স্টল বরাদ্দের তালিকা প্রকাশ করে৷ প্রকাশিত তালিকার কোথাও আদর্শর নাম নেই৷ পরের দুইদিন শুক্র-শনিবার বাংলা একাডেমি বন্ধ থাকার কারণে গত ১৫ জানুয়ারি আমি বাংলা একাডেমিতে যাই৷ মেলা কমিটির সদস্য সচিব মুজাহিদুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন যে তার কাছে এ বিষয়ে কোনো কাগজপত্র নেই৷ তিনি তার অধস্তন কর্মকর্তা কবিরের কাছে যেতে বললে কবির জানান, তার কাছে কোনো কাগজপত্র আসেনি৷’’

তিনি বলেন, ‘‘৩১ সদস্যবিশিষ্ট মেলা কমিটিতে থাকা ৪ জন প্রকাশক প্রতিনিধিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তারাও আমাকে জানান যে, তারা কিছুই জানেন না এবং কমিটির মিটিংয়েও আদর্শের স্টল বাতিলের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি৷ তখন আমি এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বাংলা একাডেমির ডিজিকে চিঠি দিয়ে আসি৷ সেই চিঠির কোনো উত্তর আমি পাইনি৷ গত ১৭ জানুয়ারি আরেকটি চিঠি দিই৷ সেই চিঠিরও অদ্যাবধি কোনো উত্তর আমি পাইনি৷’’

মাহাবুব রাহমান বলেন, ‘‘মেলা কমিটিতে থাকা একজন প্রকাশক প্রতিনিধি আমাকে জানিয়েছেন, আদর্শ থেকে প্রকাশিত ৩টি বই নিয়ে বাংলা একাডেমির আপত্তি আছে৷ পরে মেলা কমিটির সচিব মুজাহিদ ভাই ফোনে বলেন, আদর্শর বইতে সরকারবিরোধী মত রয়েছে৷ সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, বাংলা একাডেমি এখন বলছে যে আদর্শর বই বাংলা একাডেমির স্টল বরাদ্দের নীতিমালা পরিপন্থী৷ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা গেছে, এই নীতিমালা মনগড়া ও পরিবর্তনশীল৷ প্রতি বছর একুশে গ্রন্থমেলার প্রাক্কালে আয়োজক কমিটি নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নীতিমালা তৈরি করে, যার কোনো কপি লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক কাউকে দেওয়া হয় না৷ এই অদৃশ্য নীতিমালা মূলত লেখক-প্রকাশকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার কাজে ব্যবহৃত হয়, যা মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷’’

এ অবস্থায় বাংলা একাডেমির এসব তৎপরতা বন্ধের দাবি ছাড়াও ৫টি দাবি জানিয়েছে আদর্শ প্রকাশনী৷

দাবিগুলো হলো:

১৷ অমর একুশে গ্রন্থমেলায় লেখক ও প্রকাশকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত রাখতে হবে৷

২৷ অবিলম্বে আদর্শকে প্রাপ্যতা ও যোগ্যতা বিবেচনা করে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দিতে হবে৷

৩৷ আদর্শর যে ৩টি বইয়ের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি আপত্তি জানিয়েছে, সেগুলো মেলায় প্রদর্শন ও বিক্রির পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে হবে৷

৪৷ গ্রন্থমেলায় আদর্শসহ সব প্রকাশক ও লেখকদের হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে৷

৫৷ একুশে গ্রন্থমেলা প্রকাশকদের৷ অবিলম্বে এই গ্রন্থমেলার দায়িত্ব সব প্রকাশকের সমন্বয়ে গঠিত প্রকাশক গিল্ডের হাতে তুলে দিতে হবে৷

অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যসচিব এবং বাংলা একাডেমির প্রশাসন বিভাগের পরিচালক ড. এ কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘আদর্শ চার ইউনিটের স্টল পেয়ে আসছিল৷ এবার তারা প্যাভেলিয়নের আবেদন করেছিল৷ আমরাও ভেবেছিলাম তাদের প্যাভেলিয়ন দেবো৷ তবে তখনই তাদের কিছু বই নিয়ে আপত্তি আসে৷ আমরাও দেখেছি তাদের প্রকাশিত বই আমাদের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক৷ এ কারণে তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি৷ সরকারবিরোধী বিভিন্ন বক্তব্য আছে ওই বইয়ে৷’’

৩১ সদস্যবিশিষ্ট মেলা কমিটিতে থাকা ৪ জন প্রকাশক প্রতিনিধির একজন আগামী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ওসমান গনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মিটিংয়ে আদর্শ প্রকাশনী নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি৷ অবশ্যই তারা স্টল পাবে৷ না পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ অযথাই এই বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে৷ এটা না করলেও হতো৷ আমি আশা করছি, দু-এক দিনের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷’’

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷