আবারো প্রশ্নপত্র ফাঁস, দায় কার?
২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮বৃহস্পতিবার ছিল এসএসসি'র বাংলা প্রথমপত্রের পরীক্ষা৷ এবার আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়৷ এরমধ্যে অন্যতম ছিল পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার হলে হাজির থাকা বাধ্যতামূল করা৷ আর এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় পরীক্ষার্থী এবং অভিাবকদের মধ্যে৷ আরো যেসব ব্যবস্থা নেয়া হয় তার মধ্যে আছে: পরীক্ষার আগে থেকেই দেশের সব কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দেয়া, কেন্দ্র সচিব ছাড়া পরীক্ষাকেন্দ্রে আর কাউকে মোবাইল নিয়ে প্রবেশ করতে না দেয়া, কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস হলে নিয়ে যেতে না দেয়া প্রভৃতি৷
কিন্তু পরীক্ষা শুরুর একঘণ্টা আগেই ফেসবুকে চলে আসে বাংলা ১ম পত্রের বহু নির্বাচনি অভীক্ষার প্রশ্নপত্র( খ সেট)৷ আর তা ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে৷ কথা ছিল, ফেসবুকে প্রশ্ন পাওয়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)-কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হবে, তাও জানানো হয়নি৷ আর পরীক্ষা শুরুর আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেই পরীক্ষা বাতিল হবে৷
এবারের এই প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনে যারা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন তাদের একজন হলেন সাংবাদিক সাদ্দিফ অভি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পরীক্ষা শুরুর এক ঘণ্টা বা তার কিছু আগেই আমরা ফেসবুকে প্রশ্নপত্র পাই৷ আর পরীক্ষা শেষ হলে ফেসবুকের ওই প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের শতভাগ মিল পাই৷ আর আমরা ফেসবুকে পাওয়ার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেও তা জানাই৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এবার প্রশ্নপত্র ফাঁসে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়৷ তারমধ্যে কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখা অন্যতম৷ তাই ঠিক কারা এবারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত, তা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না৷’’ তিনি জানান, ‘‘এবার বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়৷ আমরাও সেটা ধরেই পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র পাই৷ তবে এটা নিয়ে ব্যবসা আগেই হয়ে যায়৷ কারণ, যারা জানেন, তারা ফেসবুকের ওইসব গ্রুপ থেকে এমনিতেই প্রশ্নপত্র নিতে পারেন৷ পয়সা খরচ করতে হয় না৷ টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র দেয়া হয় হোয়াটস অ্যাপ, ইমো বা ভাইবারের মতো অনলাইন অ্যাপস-এ৷’’
তাহলে ফেসবুকে কেন দেয়া হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে সাদ্দিফ অফি বলেন, ‘‘এটা দিয়ে বাজার সৃষ্টি করা হয়৷ তারা যে সত্যিই প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে তা প্রমাণ করতে৷ এর ফলে পরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের জন্য আরো নতুন গ্রাহক পাওয়া যায়৷ তবে কেউ কেউ এদের প্রতারণারও শিকার হন৷’’
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনেক হাঁকডাক দেয়ার পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠোকাতে পারেনি৷ তারা কোচিং সেন্টার বন্ধ করে, পরীক্ষার্থীদের আধাঘণ্টা আগে হলে আসতে বাধ্য করে৷ ফেসবুক বন্ধ করার কথা বলে৷ কিন্তু আসল কাজ হয় না৷ প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় যেখান থেকে ছাপা হয় সেই বিজি প্রেস অথবা যারা এর বিতরণের দায়িত্বে থাকেন, সেই মন্ত্রনালয় বা শিক্ষা বোর্ডের লোকজনের কাছ থেকে৷ আমরা এখনো তাদের চিহ্নিত করে আটক বা ব্যবস্থা নিতে দেখি না৷ তারা উল্টো পরীক্ষার্থী, অভিভাবকদের হয়রানি করেন৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো না গেলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে৷ অনেকেই পড়াশুনা না করে প্রশ্নপত্রের পিছনে ছুটছে৷ আবার কেউ তেমন পড়াশুনা না করে পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র পেয়ে ভালো ফল করে৷ ফলে শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন৷’’
তবে এবারো প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা বোর্ড৷ তারা বলছে, ফাঁসের কোনো প্রমাণ তারা পাননি৷ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক তপন কুমার সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো প্রমাণ বা নমুনা পাইনি৷ আমাদের পরীক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে পরীক্ষার হলে ঢুকে গেছে, তারাও কোনো প্রশ্নপত্র দেখেনি৷ আমরা নিজেরাও অভিযোগ পাওয়ার পর অনুসন্ধান করে দেখেছি, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো ঘটনা ঘটেনি৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আগে কিছু কিছু জায়গায় দুর্বলতা ছিল বলেই এবার আমরা আগে থেকেই নানা ব্যবস্থা নিয়েছি৷ কোচিং সেন্টার বন্ধ করেছি৷ পরীক্ষার্থীদের আধাঘণ্টা আগে হলে এনেছি৷ আর প্রশ্নপত্র ছাপ থেকে বিতরণ পর্যন্ত নিরাপত্তার জন্য এবার আমাদের লোক ছিল৷’’
প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে পারে চারটি পক্ষ, যাঁরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন চূড়ান্ত করেন, যাঁরা ছাপার কাজে যুক্ত, যাঁরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবহণ ও বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকেন৷ এই চারপক্ষের বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁরা মূলত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের ব্যবসা করেন৷ অভিভাকদের অনেকে মনে করেন, ওই চার পক্ষের মধ্যেই অপরাধী আছে এবং তাঁদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিলে প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ হবে না৷
প্রসঙ্গত, এবার প্রথমবারের মতো সব শিক্ষা বোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা হচ্ছে৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...