জার্মানির ‘ইমেজ’ সমস্যা
২৮ মার্চ ২০১৩ইউরো সংকটের সূচনা যাবৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে একই ধরনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া গেছে: ক্রুদ্ধ বিক্ষোভকারীদের হাতের প্ল্যাকার্ডে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল'কে নাৎসি ‘সোয়াস্তিকা' বা স্বস্তিকা মার্কা নাৎসি উর্দি পরিয়ে, তাঁর মুখে হিটলারি গোঁফ এঁকে কার্টুন চিত্র করে দেখানো হচ্ছে৷ গ্রিস, ইটালি কি সাইপ্রাস - যে দেশের নিজেদের যতোটা দায়িত্বই থাক না কেন, শেষমেষ যত দোষ নন্দ ঘোষ পদ্ধতিতে জার্মানিকেই দোষী করা হচ্ছে৷ যেন জার্মানি দাবি না করলে ইউ ট্রোইকা কিংবা আইএমএফ সম্পূর্ণ অন্য সিদ্ধান্ত নিতো, অনেক নরম শর্ত আরোপ করতো৷
নাৎসিদের সঙ্গে তুলনা
বিপদে পড়লে কেউই নিজের দোষ দেখে না, অপরকেই দোষী করতে চায়৷ ইউরোপের সুবিধা হল, জার্মানি থাকতে আর দোষী খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি তো আছেই৷ ব্যাপারটা এতোদূর এগিয়েছে যে, স্পেনের ‘এল পাইস'-এর মতো দৈনিকের ওয়েবসাইটে সেভিইয়া'র এক অর্থনীতির অধ্যাপক, হুয়ান টরেস লোপেজ, নির্দ্বিধায় ম্যার্কেলকে হিটলারের সঙ্গে তুলনা করে বসে আছেন৷ লোপেজ লিখেছেন: ‘‘হিটলারের মতো আঙ্গেলা ম্যার্কেলও বাকি ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, তবে এবার ‘লেবেন্সরাউম' বা রাজ্যাঞ্চলের জন্য নয়, অর্থনৈতিক রাজ্যাঞ্চলের জন্য৷'' প্রবন্ধটি ইত্যবসরে ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে৷
খানিকটা ঈর্ষাও
আসলে সমস্যাটা হল এই যে, ইউরোপের অর্থনৈতিক আঙ্গিকে জার্মানির নেতৃস্থানীয় ভূমিকা অনস্বীকার্য - কথাটা বলেছেন ব্রাসেলস'এর ‘ইউরোপিয়ান পলিসি সেন্টার'-এর ইইউ-বিশেষজ্ঞ ইয়ানিস এম্মানুইলিডিস৷ ডয়চে ভেলের সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন: ‘‘জার্মানির আয়তন এবং জার্মানি যে অন্য সকলের চেয়ে ভালোভাবে আর্থিক সংকটের মোকাবিলা করতে পেরেছে, এই দু'টি কারণে বাকি সকলেই জার্মানির দিকে তাকিয়ে৷ ইউরোপে জার্মানির মতামত ও ধ্যানধারণার গুরুত্বই সবচেয়ে বেশি৷''
প্রাশিয়ান নীতিবাগিশ
অপরদিকে ইউরো এলাকায় জার্মানি এখন ‘‘আধিপত্য, শৃঙ্খলা অথবা ব্যয়সংকোচের'' প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে, বলে ‘আইরিশ টাইমস' দৈনিকের বার্লিন সংবাদদাতা ডেরেক স্ক্যালি'র অভিমত৷ স্ক্যালি বিগত ১৩ বছর ধরে বার্লিনে আছেন এবং জার্মানির ক্রমবর্ধমান ‘ইমেজ' সমস্যা নিয়ে ইতিপূর্বেও লিখেছেন৷ বহির্বিশ্ব জার্মানদের সেই ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা প্রাশিয়ান নীতিবাগিশ হিসেবেই দেখে: সব কিছুর জন্য স্পষ্ট নিয়ম থাকা চাই এবং সেই নিয়ম পালন করা চাই, রাজনৈতিক বাস্তব যাই হোক না কেন৷ এই নাকি হল জার্মানদের মনোভাব৷
জার্মানদের এই ভাবমূর্তির জন্য বিদেশী গণমাধ্যমেরও দোষ দেখেন স্ক্যালি৷ সাধারণত জার্মানিতে কি ঘটছে না ঘটছে, তা সরাসরি উপেক্ষা করা হয়৷ যেমন জার্মান সরকার যখন জার্মানিতে দারিদ্র্য বৃদ্ধি নিয়ে সংসদে রিপোর্ট পেশ করেন, তখন বিদেশী মিডিয়ায় তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হয় না৷ কিন্তু সংকট দেখা দিলেই জার্মানদের চিরাচরিত, মান্ধাতার আমলের ছবিগুলো টেনে বার করা হয়৷ তার সঙ্গে হয়তো সেই মান্ধাতার আমলের কিছু বিরূপতা ও বিদ্বেষ৷
দায় সকলেরই
অপরদিকে জার্মানরাও মাঝেমধ্যে এমন কথা বলে ফেলেন, যেগুলো না বললেই বোধহয় ভালো হতো৷ ব্রাসেলস'এর ইইউ-বিশেষজ্ঞ এম্মানুইলিডিস একটি উদাহরণ দিলেন: ‘‘যখন আমরা শুনি, জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল ইঙ্গিত করেছেন যে, গ্রিকরা নাকি কম কাজ করে - তখন তার একটা প্রতিক্রিয়া হয় বৈকি৷'' আজ হয়তো ম্যার্কেল কথাটা বলতেন না, বলে এম্মানুইলিডিস'এর ধারণা৷ এম্মানুইলিডিস লক্ষ্য করেছেন, আর্থিক সংকটে জার্মানির যে অবস্থান, নেদারল্যান্ডস কিংবা ফিনল্যান্ডের মতো ছোট অথচ সমৃদ্ধশালী দেশগুলি তা সমর্থন করে - কিন্তু প্রকাশ্যে নয়৷ এক্ষেত্রে জার্মানির পিছনে আত্মগোপন করাটাই নিরাপদ বলে মনে করে তারা৷
জার্মানি একা তার ইমেজ সমস্যার সমাধার করতে পারবে বলে এম্মানুউলিডিস কি স্ক্যালি'র মতো বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না৷ ইউরোপীয় পর্যায়ে তথাকথিত ব্যাংকিং ইউনিয়ন একটি পন্থা হতে পারে, কেননা তার ফলে ইউরো এলাকার কাঠামো- ও পদ্ধতিগত কিছু গলদ দূর করা সম্ভব হবে, এবং ‘নন্দ ঘোষ' জার্মানিও কিছুটা দায়মুক্ত হবে৷