ইন্টারনেট নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২ধরুন, আপনি ইন্টারনেট থেকে একটি সফটওয়্যার ডাউনলোড করলেন৷ কিন্তু আপনার অজান্তেই ঐ সফটওয়্যারের মাধ্যমে কম্পিউটারে ঢুকে পড়লো ট্রোজান ম্যালওয়্যার৷ ব্যস, তারপর আপনার কম্পিউটারের উপর আর আপনার একার কর্তৃত্ব থাকবে না৷ অন্য কেউ একজন দূর থেকে আপনার কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রক হয়ে যাবে৷
এভাবেই কাজ করে ট্রোজান ম্যালওয়্যার৷ নামটা এসেছে গ্রিক মিথোলজির ‘ট্রোজান যুদ্ধ' থেকে৷ ট্রয় নগরীর জন্য গ্রিকদের সঙ্গে ট্রোজানদের যুদ্ধ হয়েছিল৷ এক পর্যায়ে গ্রিকরা কাঠের একটি বড় ঘোড়া তৈরি করে তার মধ্যে তাদের দক্ষ সৈন্যদের ঢুকিয়ে দেয়৷ তারপর সেটা ট্রোজানদের এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ তখনকার দিনের যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, ঘোড়াটা দেখে ট্রোজানরা খুশি হয়ে উঠে৷ কেননা, সেসময় কেউ যুদ্ধে পরাজয় মেনে নিতে নিজের ঘোড়াটা শত্রুপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিত৷ বড় কাঠের ঘোড়াটাকে গ্রিকদের পরাজয় স্বীকারের উপহার মনে করে ট্রোজানরা নিজেদের এলাকায় নিয়ে যায়৷ এভাবে দক্ষ গ্রিক সৈন্যরা ট্রোজানদের এলাকায় ঢুকে পড়ে৷ পরে রাতের বেলায় তারা শহরের দরজা খুলে দিয়ে অন্যান্য গ্রিক সেনাদের ট্রোজানদের শহরে ঢুকতে সহায়তা করে৷ পরে যা হবার তাই হয়৷ ট্রোজানদের পরাজয় মেনে নিতে হয়৷
কাঠের ঐ ঘোড়াটির নাম ট্রোজান৷ ম্যালওয়্যারটির নামও এসেছে ঐ ঘোড়ার নাম থেকে৷ কেননা ম্যালওয়্যারটি ঐ ঘোড়ার মতোই একটি সফটওয়্যারের মধ্যে ঢুকে কোনো ব্যক্তির কম্পিউটারে ঢুকে পড়ে৷ তারপর যা সর্বনাশ করার করে ফেলে৷
অ্যান্টি-ভাইরাস প্রস্তুতকারক বিখ্যাত কোম্পানি ম্যাকাফি৷ এর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টোরাল্ভ দিরো৷ তিনি বলছেন, প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ ট্রোজান ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে৷ ফলে চিন্তিত বিশ্লেষকরা৷ কেননা এর ফলে বড় বড় কোম্পানির নিরাপত্তা হুমকির মুখে৷ শুধু তাই নয় মানুষকে সেবা দেয়ার যে প্রতিষ্ঠান, তাদের কম্পিউটারগুলো যদি এভাবে ট্রোজানের কবলে পড়ে, তাহলে পুরো সেবাটাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ যেমন বিদ্যুৎ সরবরাহের আধুনিক এক ব্যবস্থার নাম স্মার্ট গ্রিড৷ ইন্টারনেটের মাধ্যমে এটা পরিচালিত হয়৷ ফলে হ্যাকাররা যদি কোনো ভাইরাসের মাধ্যমে এই গ্রিড ব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি করে তাহলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে৷ এতে বিপদে পড়তে পারে বহু মানুষ৷
একই সমস্যা হতে পারে এটিএম মেশিনের ক্ষেত্রেও৷ সেক্ষেত্রে এটিএম বুথ থেকে টাকা নাও তোলা যেতে পারে৷ আর বিমানবন্দরের কম্পিউটারে গন্ডগোলের জন্য যাত্রীদের যাত্রা বাতিল করতে হতে পারে৷
এসব কারণে ইন্টারনেটের নিরাপত্তা সমস্যার সমাধানে নিয়ে কী করা যেতে পারে তা নিয়ে জার্মানির বন শহরে হয়ে গেল একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন৷
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড ক্যামেরার বলেন, ‘‘দুই বছর আগে আমরা হ্যাকারদের কাছ থেকে একটি ‘বটনেট' চুরি করেছিলাম৷ এরপর দশদিন পর্যন্ত সেটার নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে ছিল৷ এরপর আবার হ্যাকাররা সেটা আমাদের কাছ থেকে চুরি করে নেয়৷''
তবে এই দশদিনে অনেক তথ্য নিতে পেরেছেন বলে জানান অধ্যাপক ক্যামেরার৷ যেমন নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোন্ ফাঁক ব্যবহার করে হ্যাকাররা ‘হ্যাক' করে থাকেন সেটা জানার চেষ্টা করেছেন তিনি৷ তবে হ্যাকাররা কীভাবে এতো নিরবে কাজ করে সেটা পুরোপুরি জানা সম্ভব হয়নি৷ অধ্যাপক ক্যামেরার বলেন, হ্যাকাররা প্রতি ঘন্টায় বেশ কয়েকবার ডোমেইন পরিবর্তন করে কাজ করে থাকে৷
ডয়চে টেলিকমের গ্রুপ আইটি নিরাপত্তা বিভাগের প্রধান থোমাস চেরজিশ মনে করেন, সমস্যার সমাধানে কম্পিউটার প্রস্তুতকারকদের এগিয়ে আসতে হবে৷ তাদের এমন কম্পিউটার তৈরি করতে হবে যেটা ভাইরাস, ম্যালওয়্যার এসব প্রতিহত করতে সক্ষম৷
বর্তমানে প্রযুক্তির উন্নতির কারণে কম্পিউটারের সঙ্গে স্মার্টফোন, ডিজিটাল টেলিভিশন, প্রিন্টার সহ অন্যান্য পণ্যের সংযোগ ঘটিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এতে সমস্যা আরও বাড়ছে৷
এতোটা ডিজিটাল হওয়া ঠিক কীনা সে প্রশ্ন তুলেছেন ম্যাকাফির কর্মকর্তা দিরো৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের কী এমন ডিজিটাল ফ্রিজ আসলেই দরকার যেটা নিজে থেকেই দুধ বা মাছের অর্ডার দেবে? কেননা এক্ষেত্রে যে সমস্যাটা হতে পারে সেটা হলো, হ্যাকারদের কল্যাণে পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে, হয়তো সকালে আপনি ঘুম থেকে উঠে দেখলেন যে আপনার বাড়ির সামনে ট্রাককে ট্রাক ভর্তি দুধ আর মাছ হাজির!''
প্রতিবেদন: ফাবিয়ান স্মিট / জেডএইচ
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী