ভারতের বিশ্বকাপ স্বপ্ন
১৩ অক্টোবর ২০১৪ভারতের সবথেকে জনপ্রিয় খেলা কী? অবশ্যই ক্রিকেট৷ শহর-গ্রামের মাঠে ময়দানে, অলিতে গলিতে একখানি ব্যাট আর একটা ক্যাম্বিসের বল থাকলেই ছেলেপিলেরা মহা উৎসাহে নেমে পড়ে খেলতে৷ আসলে একসময় যেটা ডান্ডা-গুলি বা ডাংগুলি ছিল, সেটাই ভোল বদলে হয়ে গেছে ক্রিকেট৷ তবু কিন্তু ফুটবল ভারতীয়দের, বিশেষ করে বাঙালিদের হৃদয়ের অত্যন্ত কাছের খেলা৷ প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে যে ধরনের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়, ফুটবলে তার ছিটেফোঁটাও নয়৷ তার সবথেকে বড় কারণ অবশ্য এটাই যে ভারতীয় ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যে পরিমাণ সাফল্য আনতে পেরেছে, জাতীয় ফুটবলাররা তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেননি৷ ভারতীয় ফুটবলের সাফল্যের কথা বলতে গেলে এখনও সেই ১৯৫৬ সালের এশিয়ান গেমসে সোনা পাওয়ার গল্প বলেই স্লাঘা বোধ করতে হয়৷
সেখানে সুপার ফুটবল লিগ করে ভারতীয় ফুটবলের কতটা উপকার হবে! উদ্যোক্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলাররা এ দেশে খেলতে এলে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন আধুনিক, উন্নত ক্রীড়াকৌশল৷ তাঁদের সঙ্গে খেলতে নামলে দেশীয় ফুটবলার যাঁরা, তাঁদের ক্রীড়ানৈপুণ্যেরও একটা মানোন্নয়ন ঘটতে পারে৷ আধুনিক প্রশিক্ষণেরও একটা প্রভাব বিদেশি খেলোয়াড়দের থেকে পড়তে পারে এ দেশের ফুটবল শিক্ষায়৷ কিন্তু সত্যিই কি সেরকম কিছু ঘটতে পারে? কলকাতার মাঠেই বিদেশি ফুটবলার তো নেহাত কম আসেনি৷ সেই সত্তরের দশকের শেষদিকে দুই ইরানি ফুটবলার মজিদ বাসকের এবং জামশেদ নাসিরি থেকে শুরু করে নাইজেরিয়ার চিমা ওকেরি, ব্রাজিলের হোসে রামিরেজ ব্যারেটো৷ আর এখন তো লিগ ফুটবলে বিদেশি খেলোয়াড়দের ছড়াছড়ি৷ খেলা দেখতে বসলে মাঝে মাঝে ধন্দ হয় যে দেশীয় ক্লাবের খেলাই দেখছি তো! এদের থেকে ঠিক কতটা শিখেপড়ে নিতে পেরেছে আমাদের খেলোয়াড়রা?
না, আসলে আরও একটা কথা আছে এই সুপার লিগের আয়োজনের পিছনে, যেটা আদৌ গোপন করার চেষ্টা করছেন না উদ্যোক্তারা৷ ইউরোপের বিখ্যাত এবং বিত্তবান ফুটবল ক্লাবগুলো যদি এই উপমহাদেশের ফুটবলের দিকে একটু কৃপাদৃষ্টি দেয় এবং যে কোটি কোটি ইউরো অথবা ডলার তারা খরচ করে প্রতি বছর, তার ছিটেফোঁটাও যদি এদিকে এসে পৌঁছায়, তা হলেও বর্তে যাবে ভারতীয় ফুটবল! তার কারণ, এই গোলার্ধ্বে ফুটবলের উন্নতি না হওয়ার অন্যতম বড় কারণ হলো প্রশিক্ষণসহ যাবতীয় পরিকাঠামো না থাকা, যার পিছনে আছে চূড়ান্ত অর্থাভাব৷ এমনকি বড় ক্লাবগুলোরও যথেষ্ট পয়সা নেই, ফলে প্রায় সবসময়ই হাত পাততে হয় কোনও বড় শিল্পপতি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে, যার পরিণতি সবসময় সুবিধাজনক হয় না৷ এই মুহূর্তে যেমন কলকাতার তিনটি বড় ক্লাবের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে তালা দিয়ে রেখেছে আর্থিক দুর্নীতির তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট৷ কারণ, এমন এক চিট ফান্ড সংস্থার থেকে তারা টাকা নিয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে বেআইনি পনজি স্কিমের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সঞ্চয় আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছে৷
বিদেশি ক্লাবের থেকে অর্থসাহায্য এলে হয়ত এই সমস্যার থেকে মুক্তি পাবে ভারতীয় ফুটবল৷ তাছাড়া ইউরোপিয়ান লিগ ফুটবলের বিখ্যাত খেলোয়াড় মানে আন্তর্জাতিক স্পনসর সংস্থাদের দাক্ষিণ্য পাওয়ার সম্ভাবনা৷ সেই সুবাদে দেশীয় স্পনসর সংস্থারা, যারা এতদিন ক্রিকেট ছাড়া অন্য কোনো খেলাকে ধর্তব্যের মধ্যে রাখত না, তাদেরও চোখ খুলে যেতে পারে৷ কারণ এটা যেমন ঠিক যে স্পনসর দিয়ে একজন শচীন টেন্ডুলকার বা (বানাভেদে তেন্ডুলকর) মহেন্দ্র সিং ধোনি তৈরি হয় না, তেমন এটাও ঠিক যে কোনো খেলা ঠিকঠাক আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পেলে, খেলাটা নিয়মিত প্রচারের আলোয় থাকলে নবীন প্রতিভা খুঁজে পাওয়ার কাজটাও একটা স্বাভাবিক ছন্দ পায়৷ ইন্ডিয়ান সুপার লিগের উদ্যোক্তারা এমন স্বপ্নও দেখাচ্ছেন যে বিদেশি ফুটবল ক্লাবরা এসে তাদের নিজেদের দলের জন্যেও খেলোয়াড় খুঁজতে পারে এখান থেকে, যদি কারও খেলা তাদের মনে ধরে যায়!
তবে সেরা স্বপ্ন দেখিয়েছেন ভারতের কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী৷ ইন্ডিয়ান সুপার ফুটবল লিগের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেছেন, লক্ষ্য হবে ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ! খুব বেশি দূরে নয় সময়টা, মাত্র আট বছর পরেই ভারতীয় ফুটবল দল বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের হার্ডল রেস জিততে পারবে, এমনটাই ভাবাতে চান ক্রীড়ামন্ত্রী৷ কিন্তু যে দেশ এখনও এশীয় পর্যায়ের সবকটি প্রতিযোগিতামূলক খেলার যোগ্যতামান পার হতে পারে না, সেই দেশের পক্ষে এমন আশা করাটা আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত! অবশ্য এটাও ঠিক, স্বপ্নের পোলাওয়ে ঘি ঢালতে কার্পণ্য করা উচিত নয়!