উন্নয়নের নামে গাছে হাত! মানছে না দিল্লি
২৮ জুন ২০১৮‘আমাকে কেটে ফেলো না, বড্ড কষ্ট হয়' – ভারতের রাজধানী দিল্লি শহরে কয়েক হাজার গাছ চিৎকার করে এমনটাই বলছে৷ তাদের গায়ে এমনই পোস্টার৷ সবাই জানেন, গাছবিহীন মানব সমাজ অসম্ভব, অবাস্তব৷ বৃষ্টির জন্য গাছ আবশ্যিক৷ সাধারণত এক একর জমিতে লাগানো গাছ বছরে ১৮ জন মানুষের অক্সিজেনের প্রয়োজনিয়তা মেটায়৷ তাই আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ ছুটে যাচ্ছেন আত্মীয়ের মতো গাছেদের জড়িয়ে ধরতে৷
ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহর দিল্লি৷ মাত্রাচাড়া বায়ুদূষণে প্রাণ ওষ্ঠাগত৷ এর বিহিত কী হবে তা না ভেবে, একসঙ্গে কয়েক হাজার পুরোনো বড় গাছ কেটে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে সরকারের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নানা মহল৷
এদিকে দিল্লিতে ১২.৭৪ শতাংশ, অর্থাৎ ১৮৯ বর্গ কিলোমটার সবুজাঞ্চল রয়েছে৷ কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো, প্রতিবছর দিল্লিতে গাছের সংখ্যা কমে চলেছে৷ এই অবস্থায় গাছ লাগানোর পরিবর্তে উন্নয়নের নামে গাছ কাটার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে৷ সরকারি কর্মকর্তাদের বাংলো এবং মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরির জন্য প্রায় বিপুল সংখ্যক গাছ কাটার পরিকল্পনা তৈরি করেছে সরকার৷ খবর পেয়েই শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন৷ আদালতে মামলা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আর্জি জানানো হয়েছে৷ চূড়ান্ত রায় না হলেও আপাতত আগামী ৪ জুলাই পর্যন্ত গাছ কাটায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আদালত৷
গবেষক কাঞ্চি কোহলি গত দু'মাস ধরে আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন৷ এক সাক্ষাৎকারে ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘সরকারি প্রকল্পটি নিয়ে কথা চলছিল গত কয়েকমাস ধরে৷ তারপরেই এইসব এলাকার মানুষ ধীরে ধীরে প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিলেন৷ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, যারা পরিবেশ দূষণ নিয়ে কাজ করে তারাও এগিয়ে এসেছে৷ সবারই প্রশ্ন, একসঙ্গে এতগুলো ৪০-৫০ বছরের পুরোনো গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হলো? এলাকার মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় এই প্রতিবাদের কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে৷ সরকারের কাছে লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে৷ একটি মামলা করা হয়েছে৷ এখন সরকার কী পদক্ষেপ নেয় সেই দিকেই সবার নজর৷''
সরকারের নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের ‘রিডেভলপমেন্ট প্ল্যান'-এ অ্যামেরিকার ওয়ার্ড ট্রেড সেন্টারের কায়দায় সুউচ্চ আবাসন টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার৷ নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ‘ন্যাশনাল বিল্ডিং কনস্ট্রাকশান কর্পোরেশন' এবং ‘সিপিডব্লুডি'৷ এই দুই সংস্থা দক্ষিণ দিল্লির সরোজিনী নগর (৮,৩২২), নৌরোজি নগর (১৪৬৫), নেতাজি নগর (২৩১৫), কস্তুরবা নগর (৭২৩), মহম্মদপুর (৩৬৩), শ্রীনিবাসপুরী (৭৫০) এবং ত্যাগরাজ নগরের (৯৩) প্রায় ১৪,০৩১টি গাছকে চিহ্নিত করেছে৷ সরকারের দাবি, এই গাছগুলি কেটে নিয়ে প্রায় দেড় লাখ গাছ লাগাবে তারা৷ প্রতিবাদের একেবারে শুরুর দিকে ফেসবুকে ‘Delhi Trees SOS' পেজ খুলে তার ব্যানারে প্রচার চালানো হয়৷ তারপর প্রথমদিন ২৫০ জন প্রতিবাদী প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামেন৷ তা দেখে আরও মানুষ এগিয়ে আসেন৷ তারপর আরও৷ আরও পোস্টার৷ কোনোটিতে লেখা ‘নিষিদ্ধ করা হোক গাছ কাটা', কোনটাতে লেখা, ‘দিল্লিকে মরুভূমি হতে দেব না৷'
তবে সুখবর হলো, আপাতত দিল্লিতে কোনো গাছ কাটা হবে না৷ স্থগিতাদেশ দিয়ে জানিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট৷ আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন কে কে মিশ্র নামে জনৈক পরিবেশপ্রেমী৷ তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে এই স্থগিতাদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট৷ এই বিষয়ে গ্রিন ট্রাইব্যুনালে শুনানি হবে আগামী ২ জুলাই৷
আগে ব্যবসা করতেন৷ এখন পরিবেশ রক্ষায় জীবনপণ করেছেন দক্ষিণ দিল্লির এই বাসিন্দা৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘বাড়ির সামনের কোনো গাছের সঙ্গে শিশু অবস্থা থেকেই সম্পর্ক তৈরি হয়৷ মা-ঠাকুরমাদের কোলে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর মতোই বাড়ির সামনে গাছের ডালে চড়ে বড় হই আমরা৷ এমন ৪০-৫০ বছরের পুরনো গাছকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত কীভাবে মেনে নেওয়া যায়? এরপর তো পরিবেশ দূ্যণের বিষয় আছে৷ দিল্লির দূষণ সম্পর্কে নতুন করে কাউকে কিছু বলার নেই৷ এখন পুরোনো বড় গাছ কেটে নিয়ে চারাগাছ লাগানো হলে সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? এইসব প্রশ্নের জবাব নেই সরকারের কাছে৷''
আন্দোলন সম্পর্কে বলতে গিয়ে রাজীব সুরী আরও জানালেন, ‘‘গাছ কাটার খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ার গ্রুপে৷ যে যার মতো নিজেদের পরিচিতদের আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন৷ তারপর সবাই একজোট হয়ে প্রশাসনের নজর কেড়েছেন৷ এখন সরকারের কাছে বিনম্র আবেদন জানানো হচ্ছে যাতে তার আতাদের প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে নেয়৷''
একসঙ্গে এতগুলি গাছ কেটে ফেলার খরবে দিল্লি সাক্ষী থাকল ‘চিপকো' আন্দোলনের৷ নানা বয়সের নাগরিক একসঙ্গে জড়ো হয়ে পোস্টার হাতে শান্তিপূর্ণ ভাবে পথে হাঁটলেন৷ গাছকে জড়িয়এ ধরে বললেন, ‘কাটতে দেব না' – এটাই চিপকো আন্দোলন৷ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘গ্রিন রাইট'-এর সক্রিয় কর্মী অনিল সুদ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কীসের ভিত্তিতে এই প্রকল্পে ছাড়পত্র দিল কেন্দ্রীয় সরকার? ছাড়পত্র দেওয়ার আগে সরকার গাছ কাটার বিষয়টিকে যথেষ্ট দেয়নি৷ অত্যন্ত ঘন বসতিপূর্ণ এলাকায় হাজার হাজার গাছ কেটে ফেললে পরিবেশে তার কু-প্রভাব পড়বেই৷ আরও দূষিত হবে এলাকা৷ এদিকে এতদিন ধরে কেন্দ্রের তরফে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল, যে সংখ্যক গাছ কাটা হবে ঠিক সেই সংখ্যক গাছই নতুন করে লাগানো হবে৷ এখন যখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে খোদ কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘ওই এলাকায় কোনো গাছ কাটা হবে না৷ তবে উন্নয়ন হবে৷'' কিন্তু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই আশ্বাসে মোটি চিঁড়ে ভিজছে না৷ সরকারি বিজ্ঞপ্তি না দিলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন প্রতিবাদীরা৷