এ কেমন সামর্থ্য, যা কখনো হয় না?
১৯ জুন ২০২০করোনা মহামারি শুরু হবার পর থেকে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আলোচনার শেষ নেই৷ ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যখাত, কতটা বেহাল দশা তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে এই করোনা -এমন সব কথায় মূল ধারার ও সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব৷ হবেই বা না কেন? পরিচিত-অপরিচিত বহু মানুষকে দেখেছি, করোনায় আক্রান্ত হলে হাসপাতালে যাবেন না ঠিকই করে রেখেছেন৷ অনেকে সর্দি কাশি শ্বাসকষ্টের উপসর্গ থাকার পরও সত্যিই যাননি৷ আবার অনেকে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ঘুরেও চিকিৎসার সুযোগ পাননি৷ এমন ঘটনা একের পর এক দেখা যাচ্ছে৷
এখন প্রশ্ন হল, বাংলাদেশের মানুষের এখানকার স্বাস্থ্যখাতের ওপর আস্থার অভাব কি আজ থেকে? অবশ্যই না৷ এ বিষয়ে তাদের অভাব অভিযোগের সীমা নেই, ছিল না কখনো৷ এই মানুষগুলোই ভারতের মাদ্রাজ বা পুনেতে চিকিৎসার জন্য যান৷ ভারতের ভিসা অফিসে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা৷ অনেকে যান সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, লন্ডন৷ তো যারা সবসময় দেশের বাইরে যান চিকিৎসা নিতে, তারা এবার পড়েছেন বিপাকে৷ করোনার সময় তো আর বাইরে যেতে পারবেন না৷ তাই দেশেই নিতে হবে চিকিৎসা৷ সমাজের এলিট শ্রেণির দু'চারজন অবশ্য চার্টার্ড বিমানে বিদেশ পাড়ি দিয়ে বেঁচেছেন৷ কিন্তু বাকিরা? তাদের চাপ বেড়েছে৷ তো এই চাপ এমনই হয়েছে, তা সামলাতে গিয়ে এই ভঙ্গুর দশা৷ আমার ধারণা, আস্থা ফিরিয়ে আনার এতটা চাপ চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর সম্ভবত এবারই প্রথম পড়েছে৷
তো চাপ দিলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? হবে না৷ কারণ এই পরিস্থিতি তো একদিনে তৈরি হয়নি৷ যুগ যুগ ধরে তৈরি হয়েছে৷ আমরা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভারত বা সিঙ্গাপুরের মত নিতে না পেরে আমরাই চিকিৎসার জন্য ভারত-সিঙ্গাপুর গিয়েছি৷ কিন্তু নিজেরা খুব বেশি বদলাইনি৷
যাই হোক, এত সব দেখে ভাবলাম এবার হয়ত হবে৷ কারণ, এবার সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকেরাও টের পাচ্ছেন৷ সাধারণ গরীব-মধ্যবিত্তরা সবই মেনে নেয়৷ কিন্তু ধনী বা প্রভাবশালীদের ওপর এলে পরিবর্তন হয়৷ যেমন ধরুন, এই করোনা যদি আফ্রিকা বা এশিয়ার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে এ নিয়ে এত কথা কেই বা বলত? আজ অ্যামেরিকা-ইউরোপকে ধসিয়ে দেয়ায় এত কথা৷ এর আগে এবোলা, নিপাহ, সোয়াইন ফ্লু, সার্স, মার্সসহ কত ভাইরাস এল গেল৷ কই একটু আধটু ‘উহু আহা' ছাড়া আর কেউ কোন কথা বলেছে?
যাই হোক বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বলছিলাম৷ এত সব দেখে ভাবছিলাম, বাজেটে অন্তত স্বাস্থ্যখাত বদলের একটা রূপরেখা দেখা যাবে৷ কিন্তু কী শুনলাম? সামর্থ্য নেই, তাই বরাদ্দ কম৷ এ কেমন সামর্থ্য, যা কখনো হয় না?
বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয় প্রকল্প দেখে৷ প্রকল্প নেই, তাই বরাদ্দ নেই৷ প্রকল্প আসে মন্ত্রণালয় থেকে৷ মন্ত্রণালয় নিজেদের বাস্তবায়ন সক্ষমতা বিবেচনা করে প্রকল্প দেয়৷ কিন্তু সব প্রকল্প মন্ত্রণালয়কে বা সরকারি সংস্থাকে বাস্তবায়ন করতে হবে, এই দিব্যি কে দিয়েছে? কেন আমরা স্বাস্থ্যখাতের জন্য বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে এমন দেশি-বিদেশি সংস্থাকে জড়াচ্ছি না? শুধু অবকাঠামো তৈরি নয়, পরিচালনাতেও কেন বাংলাদেশে দক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না? আর স্বাস্থ্য মানে কি শুধু ঔষধপত্র, যন্ত্রপাতি? গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়কি? করোনার শুরু থেকেই তো সবচেয়ে দুর্বল মনে হয়েছে ব্যবস্থাপনাকে৷ করোনার মত দুর্যোগ পরিস্থিতি এলে কেমন করে মোকাবিলা করতে হবে? সেটা কে বা কারা ঠিক করবেন? কিংবা সাধারণভাবে হাসপাতালগুলোর সেবার মান নিয়ন্ত্রণ কে করছে? কেমন করে করছে?
বিশ্লেষকরা তো বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা লোকের অভাব৷ অর্থাৎ প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দু'জায়গাতেই লোকের বড় অভাব৷ তাহলে তো লোকের দক্ষতা বাড়ানোর প্রকল্প দরকার৷ সবচেয়ে বেশি দরকার মন্ত্রণালয়গুলোর দক্ষতা উন্নয়ন৷ এই যে বাজেট প্রস্তাবে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০ ভাগ, এই ব্যয়ে কি মন্ত্রণালয়গুলো আগামী বছর আরো দক্ষ হয়ে উঠবে? পূর্বের অভিজ্ঞতা কি আমাদের আশাবাদী করে?
বাজেটের আগে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান কথা বলেছিলেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷ সেখানে তিনি স্বাস্থ্যখাত প্রসঙ্গে একটি আশার কথা অবশ্য বলেছেন৷ তিনি বললেন, যদি কেউ পরেও প্রকল্প প্রস্তাব নিয়ে আসেন, এবং তা যদি বিবেচনাযোগ্য হয়, তাহলে তা দ্রুত পাশ ও বাস্তবায়ন করা হবে৷ আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তা কেমন করে সম্ভব? তিনি বললেন, নিয়ম মেনেই সম্ভব৷
সে যাই হোক, যত ক্লিশেই শোনাক কথাটা এটাই সত্য, স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ এটা একদিনে হবে না৷ কিন্তু আমরা সঠিক পথে হাঁটা শুরু করেছি, তা অন্তত দেখতে চাই৷