এতিমখানা বা পথের পাশে ঈদ যাদের
১১ এপ্রিল ২০২৪বাংলাদেশে মোট এতিম শিশু কতজন তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ইউনিসেফের হিসেবেবাংলাদেশে মোট পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এমন শিশুরা পথেই থাকে। তারা কোনো এতিম খানা বা প্রতিষ্ঠানের আওতায় নেই। নানা ধরনের ছোটখাট কাজ করে খাবার জোগাড় করে তারা। তাদের অনেকেরই বাবা-মা থাকলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর জরিপ বলছে, তাদের ৬৪ শতাংশই আর পরিবারে ফিরতে চায় না। কারণ, তাদের পরিবারের অর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আবার অনেকের পরিবারে অশান্তি।
রাকিব আহমেদ ( ১৪) থাকে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায়। তার একটি ভাইও আছে ৯ বছর বয়সের। বাবা-মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে কয়েক বছর আগে। তার দাদা ট্রাকে মাটির শ্রমিকের কাজ করে। দাদার সঙ্গেই থাকে তারা। রাকিব বেলুন বিক্রি করে তার পড়াশোনার খরচ চালায়। সে জানায়, "ঈদের দিন সকালে বেলুন বিক্রি করেছি। একজন আমাকে এবং আমার ভাইকে ঈদের জামা কিনে দিয়েছে।”
অনেক শিশু আছে যাদের ঈদে জামা তো দূরের কথা ভালো খাবারও জোটেনি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসেবে বাংলাদেশে আট হাজারের মতো এতিমখানা আছে। এতিমখানাগুলো সরকারি তালিকাভুক্ত এবং সরকারের কাছ থেকে বছরে একবার হলেও অনুদান পায়। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি হবে। কারণ, বেসরকারি পর্যায়েও অনেক এতিম খানা আছে।
নাটোরের ঝিনাপাড়া তানজিমুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিখানার পরিচালক মাওলানা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, "ঈদের সময় এতিম খানা বন্ধ থাকে। তারা যার যার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে চলে যান। কিন্তু যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, তারা থেকে যায়।”
তিনি জানান, "আমাদের এই এতিমখানায় ৩০ জনের মতো আছে। তাদের মধ্যে ১০ জনের বাব-মা কেউ নাই। তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজনও তাদের খোঁজ রাখে না। তারা ঈদে আমাদের এখানেই আছে। তাদের জন্য আমরা আজকে সেমাই এবং মাংসের ব্যবস্থা করেছি।”
"কিন্তু তাদের চোখের দিকে তাকানো যায় না। যাদের আত্মীয়রা এসে নিয়ে গেছে বা যারা একটু বড় তারা নিজেদের উদ্যোগে গেছে৷ তারা বাড়ি যাওয়ার সময় ওই শিশুরা তাকিয়েছিল। তাদের নিতে কেউ আসেনি। কেউ আসবে না। আমরা এবার তাদের নতুন জামা-কাপড় দিতে পারিনি। তবে কখনো কখনো কোনো দানশীল ব্যক্তি দিয়ে গেলে তারা যায়,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন এতিমখানাগুলোর একটি ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিম খানা। ১৯০৯ সালে এই এতিম খানা শুরু হয়। এই এতিমখানায় এখন ১৫০ জন ছেলে-মেয়ে আছে। এখানে ৯ বছর থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত রাখা হয়। তাদের বাবা অথবা মা মারা গেছেন বা নেই।
এতিমখানার জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান জানান, "আমরা ঈদে এতিমখানা ছুটি দিয়েছি। তারপরও ৩০ জন আছে, যারা এই ঈদেও এতিম খানায় আছে। আসলে তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাদের কেউ নিতেও আসেনি।”
তিনি জানান, "যে এতিমরা ঈদে আছে তাদের আজকে আমরা উন্নত খাবার দিয়েছি। সকালে ভালো নাস্তা ছিল। দুপুরে উন্নত খাবার। আর বিকেলে তাদের বিনোদনের জন্য বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে নতুন জামা-কাপড় দেয়া হয়নি। তবে তাদের পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসহ তাদের যা দরকার সবই আমরা দেই। তারপরও বাবা-মায়ের অভাব তো আমরা ঘোঁচাতে পারবো না।”
তিনি বলেন, "আমরা বাইরে দান এবং জাকাত নিই। তবে এতিমখানার জমি দখলের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে একটি গ্রুপ সক্রিয় আছে। তারা মাঝেমধ্যেই ঝামেলা করে। এর প্রভাব এতিম শিশুদের ওপরও পড়ে।”
সাইলেন্ট হ্যান্ড সাপোর্ট সোসাইটি সারা দেশে এতিম এবং অভাবী মানুষদের নিয়ে কাজ করে। তারা সরাসরি কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করে না। তারা অনলাইনে ক্যাম্পেইন করে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় এতিমদের সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, "এতিমখানাগুলো ঈদে বন্ধ থাকে। যাদের আত্মীয় স্বজন থাকে, সেখানে তারা চলে যায়। যাদের একদমই কেউ নাই, তারা এতিমখানায়ই থেকে যায়। প্রতিটি এতিমখানায়ই বেশ কিছু শিশু ঈদের সময় থাকে। তাদের জন্য এতিমখানার ফান্ড থেকে যেটুকু সম্ভব আয়োজন করে। আসলে তাদের জন্য তেমন কিছু করা হয় না।”
তিনি বলেন, এবার পাঁচটি জেলায় তারা এবার প্রায় এক হাজার মানুষকে রোজা ও ঈদে সহায়তা করেছেন। এতিমখানায়ও সহায়তা দিয়েছেন। তবে কোনো নতুন পোশাক দেননি।
‘মজার স্কুল' ঢাকাকেন্দ্রিক সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা সহায়তার একটি প্রতিষ্ঠান। তারা ঢাকা, ভোলা ও কক্সবাজারে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয় এবং তাদের শিক্ষা সহায়তা দেয়। ছোট আকারে তাদের আবাসিক ব্যবস্থাও আছে। গত ১২ বছর ধরে এই স্কুলটি কাজ করছে। এর প্রতিষ্ঠাতা আরিয়ান আরিফ। তাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা দুই হাজার ৩০০। এবার ঈদে তারা এক হাজার শিক্ষার্থীকে নতুন জামা দিয়েছেন। তিনি বলেন, "এবার ঈদে আমরা একটি গরু কিনে উত্তরা ১২ নাম্বার সেক্টরের একটি বস্তিতে ৫০০ শিশু, অভিভাককে ঈদের দুপুরে পোলাও , মাংস ও লাচ্ছা সেমাই খাইয়েছি।” "এর বাইরে রমজান মাস জুড়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের পরিবারকে সাধ্যমতো সহায়তা করেছি,” বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, "আমরা কোনো বিদেশি ফান্ডিং নেই না। সাধারণ মানুষের সহায়তায়ই এই প্রতিষ্ঠান চলে। আমরা যাকাতের অর্থ নিই।”
ধানমণ্ডির তাকওয়া মসজিদের ইমাম মুফতি সাইফুল ইসলাম বলেন, "পবিত্র ঈদুল ফিতরের শিক্ষা হলো একদিকে সংযম আর আরেকদিকে ভ্রাতৃত্ব ও উঁচু-নিচু ভেদ দূর করা। ঈদের ফিৎরার মানে হলো ঈদের দিন কোনো পরিবারে খাবার থাকবে না তা যেন না হয়। এটা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করতে হয়। রসুল (সাঃ)-র শিক্ষা ছিল- তোমার জামাটা প্রয়োজনে আরেকজনকে দিয়ে তাকে ঈদের নামাজে নিয়ে আসো। তার আনন্দই তোমার ঈদের আনন্দ। এটাই তোমার ঈদ। তিনি ছোট বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন, নতুন পোশাক বানিয়ে দিয়েছেন। তাদের নিয়ে ঈদগাঁয় ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছেন।”
তার কথা, "আমরা এখন অনেকেই এটা আর করছি না। আমরা সংযমী হতে পারছি না। আমরা সবাইকে নিয়ে ঈদের আনন্দ করতে পারছি না। এটা পারলেই প্রকৃত ঈদ আমরা খুঁজে পাবো।”
আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মুঈদ রহমান বলেন, "আমরা এক জরিপে দেখেছি, বাংলাদেশে যে পরিমাণ জাকাতযোগ্য সম্পদ আছে তার সঠিক জাকাত দেয়া হলে বছরে ৪৩ হাজার কোটি টাকা জাকাত হয়। কিন্তু সেই পরিমাণ জাকাত তো দেয়া হয় না। সম্পদশালী মুসলমানদের যে জাকাত হয়, তার সামান্য অংশই দেয়া হয়। কেউ কেউ এটা দিয়ে আবার প্রচার করেন। কিন্তু তারা জানে, মোট সম্পদের ২.৫ ভাগ দিতে হয়। এক কোটি টাকা থাকলে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা জাকাত দিতে হয়। আসলে এখন যেটা হচ্ছে সেটা ইসলাম এবং ঈদের শিক্ষা নয়।”
তার কথা, "আমাদের পুঁজিবাদী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা ধর্মও পালন করি, আবার বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাও তৈরি করি। এখানে ব্যক্তিগত সম্পদ বাড়ানোর প্রতিযোগিতা চলে। ফলে একটা ধর্মীয় কালাচার আছে। অনুশাসন নেই।”
তিনি মনে করেন, "রোজা ঈদে বিচ্ছিন্নভাবে মানুষ যে দান-খয়রাত করে, সেটাকে ভালো বললেও কার্যকর কিছু না। একটি লুঙ্গি বা শাড়ি, এক বেলা খাবার সমাজে কোনো পরিবর্তন আনে না। সরকারের জাকাত ফান্ড আছে। সেটাকে কার্যকরভাবে ব্যবহারের উদ্যোগ নিলেও কিছুটা কাজ হতে পারে।”