মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স বিপর্যয়
১৭ জুলাই ২০১৫গত বছর ১৭ই জুলাই ওলেগ ভ্টুলকিন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে টোরেস শহরে নিজের বাড়িতেই ছিলেন৷ একটা অস্বাভাবিক শব্দ তাঁকে উতলা করে তোলে৷ ডিডাব্লিউ-কে তিনি বলেন, ‘‘বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ও তারপর আরেকটি শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম৷ সেই দিকে এগিয়ে এবং অনেকের সঙ্গে ফোনে কথা বলে জানতে পারি, যে একটি বিমান গ্রাবাভো-র কাছে ভেঙে পড়েছে৷''
আধ ঘণ্টার মধ্যেই ভ্টুলকিন প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের সেই গ্রামে পৌঁছে গিয়েছিলেন৷ প্রথম ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি এমএইচ সেভেনটিন-এর ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছিলেন৷ সেটা ছিল এক অকল্পনীয় দৃশ্য৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন অভিজ্ঞতা আমার আগে কখনো হয় নি৷ তাই আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম৷ ঠিকমতো কাজ করতে পারছিলাম না, স্বাভাবিক ছবি তুলতে অসুবিধা হচ্ছিল৷ সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম৷ তারপর ছবি তুলতে শুরু করলাম৷ তখনো পর্যন্ত অন্য কেউ সেই কাজ করার জন্য ঘটনাস্থলে আসেনি৷ আমি যতটা কম সম্ভব কাজ করলাম৷''
ভ্টুলকিন যখন গ্রামের বসতি থেকে একটু দূরে এক খোলা মাঠে এলেন, তখনো বিমানের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে গনগনে আগুন দেখা যাচ্ছিল৷ আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালমপুরগামী বিমানটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের আকাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়৷ ২৯৮ জন যাত্রী ও কর্মীদের মধ্যে কেউই রেহাই পাননি৷ কিন্তু সেই ট্র্যাজেডির মাত্রা সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায়নি৷ ভ্টুলকিন বলেন, ‘‘আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, দমকলকর্মীরা এসে পড়েছিলেন৷ সৈন্যদেরও দেখা যাচ্ছিল৷'' ভাঙা গলায় তিনি আরও বলেন, ‘‘সবচেয়ে নিষ্ঠুর দৃশ্য ছিল মৃতদেহগুলি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী৷ সবকিছু পুড়ে যাচ্ছিল৷''
মানসিক টানাপড়েন নিয়ে ভ্টুলকিন ঘটনাস্থলের ছবি তোলেন৷ ‘‘ভয়ংকর সেই জায়গায় আমি থাকতে চাইনি৷ কিন্তু ফটোগ্রাফার হিসেবে সবকিছু নথিভুক্ত করতে হয়েছিল৷ ইতিহাসের স্বার্থে আমাকে ছবি তুলতে হয়েছিল৷ কিন্তু আবেগ সামলে সেই কাজ করা ছিল খুবই কঠিন৷ আমি মানুষের মৃতদেহ দেখেছি৷ চারিদিকে লাশঘরের মতো একটা অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল৷ গরমের মধ্যে মৃতদেহগুলি চারিদিকে ছড়িয়ে ছিল৷''
এক বছর পর ভ্টুলকিন বেশ কয়েকটি হার্ড ডিস্ক ঘেঁটে সেই দিনের ছবিগুলি খুঁজে পেয়েছেন৷ তিনি কখনো সেই সব ছবি বিক্রি করার চেষ্টা করেননি৷ বেশিরভাগ ছবিই প্রকাশ করার মতো নয়৷ সেই সব ছবিতে বিমানের যাত্রী ও কর্মীদের আচমকা নিষ্ঠুর পরিণতির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে৷
ভ্টুলকিন এই সব ছবির কথা মনেও করতে চান না৷ তিনি বলেন, ‘‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি ছবিগুলি না দেখার চেষ্টা করি৷ খুবই কমবার সেগুলি দেখেছি৷ এ সব ছবি না দেখাই ভালো৷''
ভ্টুলকিন এডিট না করা এই সব ছবির তালিকা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বলছিলেন, তিনি কী ভাবে সবকিছু দেখতে দেখতে ছবি তুলছিলেন৷ দমকল কর্মীরা তখন আগুনের শিখা নেভাচ্ছিলেন৷ ধ্বংসাবশেষ থেকে ধোঁয়া সরে যাচ্ছিল৷ তখন তিনি এগিয়ে গিয়ে সবকিছু নথিভুক্ত করে যাচ্ছিলেন৷ মাঠের উপর পাসপোর্টের সহ কাগজপত্রও পড়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি৷
ভ্টুলকিন পর্দায় একটি শিশুর মৃতদেহের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘‘আমাকে সবচেয়ে নাড়া দিয়েছিল পথের উপর পড়ে থাকা একটি ছোট মেয়ের লাশ৷ ছোট্ট শিশু, মৃত একটি মেয়ে৷ আমারও সন্তান রয়েছে৷ তাই এই দৃশ্য দেখা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল৷''
ভয়াবহ ছবির সংগ্রহ সরিয়ে রাখা সত্ত্বেও ভ্টুলকিন ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন৷ বিদ্রোহীরা সম্প্রতি যে সব নিজস্ব মিডিয়া প্রতিষ্ঠান খুলেছে, তাদের হয়ে কাজ করছেন তিনি৷ কিন্তু এমএইচ সেভেনটিন ভেঙে পড়ার দিনটি তাঁর স্মৃতিভাণ্ডারে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে৷ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের যে সংকট তাঁর আশেপাশের অনেক মানুষের জীবনের উপর প্রভাব রেখেছে, সেটি গোটা বিশ্বকে এ দিন নাড়া দিয়েছিল৷