1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

করোনা: অচেনা রোগ, অচেনা আতঙ্ক

মাসুদ কামাল সাংবাদিক
১৩ মার্চ ২০২০

হঠাৎ করেই যেন পাল্টে গেছে ঢাকার দৃশ্যপট৷ যানজট, ধূলিময় বাতাস, রাস্তায় গিজগিজে মানুষ- এসবই আগের মতো আছে৷ পাল্টে গেছে মানুষের মুখ৷

https://p.dw.com/p/3ZM1G
ছবি: DW/S. Hossain

প্রায় সকলের মুখে এখন মাস্ক৷ এ মাস্ক চেহারা ঢাকার মুখোশ নয়, করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সার্জিক্যাল মাস্ক৷ মাস্কে ঢাকা পড়েছে মুখ, এ মুখগুলো ভিন্ন ভিন্ন৷ কিন্তু প্রতিটা মুখে লটকে থাকা যে আতঙ্ক- সেখানে কোন ভিন্নতা নেই৷

পাল্টে গেছে মিডিয়া৷ সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় ভয় দেখানো ভঙ্গিতে করোনার শিরোনাম৷ টেলিভিশনে দুনিয়াজুড়ে কোথায় কত আক্রান্ত হলো, কত মারা গেল তার আপডেট৷ আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা প্রকাশে এরা যতটা আগ্রহী, ততটা যেন নয় রোগমুক্তি আর সচেতনতা বিষয়ক তথ্য প্রচারে৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন এ রোগ নিয়ে আজগুবি সব গুজব৷ সেদিন দেখলাম আসামের কোন বিধায়ক নাকি বলেছেন- গোমূত্রে ভালো হয় কোভিড-১৯৷ একজন একটা ছবি শেয়ার করেছেন, ফুটপাতে এক লোক বসে আছে, তার পিছনে ব্যানারে লেখা- হোমিও পদ্ধতিতে তিনি দিয়ে থাকেন করোনা ভাইরাসের ওষুধ! 

অধিকাংশ ওষুধের দোকানের কাউন্টারে বা দৃশ্যমান কোন জায়গায় নোটিশ টাঙানো- ‘মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার নেই'৷  ফুটপাতে অবশ্য মাস্ক পাওয়া যায়, তবে সেগুলো খুবই নিম্নমানের, এবং দামও বেশি৷ আগে যেটা দশ টাকায় পাওয়া যেত, এখন সেটা ত্রিশ টাকা৷ তাহলে ফার্মেসিতে নেই কেন?  এক ফার্মেসি মালিক বললেন- ভাই, আমাদের তো বিক্রি করলেই লাভ৷ মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের চাহিদা এখন খুবই বেশি৷ কিন্তু তারপরও আমরা ইচ্ছা করেই রাখছি না৷ চাহিদা বেশি বলে আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে, অথচ বিক্রির সময় দাম একটু বেশি চাইলেই ঝামেলায় পড়তে হয়৷ অনেক জায়গায় র‌্যাব অভিযান চালিয়েছে৷ রীতিমত বেইজ্জতি ব্যাপার৷ 

র‌্যাবের অভিযানের বিষয়টাও কিন্তু অমূলক নয়৷ রীতিমত ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে নিয়ে র‌্যাব বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েছে৷ কেবল রাজধানী ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও চলেছে এ অভিযান৷ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা মাস্কের দাম বেশি চাওয়ার কারণে একাধিক ওষুধের দোকানকে জরিমানা করা হয়েছে৷ সেসব আবার টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রচারও হয়েছে৷ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে খুব কাজকর্ম করছে, করোনা নিয়ে যে তারাও বেশ উদ্বিগ্ন- সেটা টের পাওয়া গেছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে মাস্ক নিয়ে এত হইচই, কেনা এবং পরার জন্য দারুন হুজুগ, তার কি সত্যই কোন দরকার আছে এখন বাংলাদেশে? 

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কিংবা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত নতুন এই ভাইরাসটি সম্পর্কে যতটুকু যা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে এতটুকু বলা যায়- মাস্ক পরার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কেবল আক্রান্ত ব্যক্তির৷ যার দেহে এই ভাইরাস ঢুকেছে, সে যাতে হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে সেটা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারে, সে জন্যই এই মাস্ক৷ কিন্তু বাংলাদেশে কি এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছে? এখন (১২ মার্চ) পর্যন্ত মাত্র তিনজন আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে৷ এরা আবার ভালোও হয়ে গেছে৷ এটা অবশ্য সরকারি হিসাব৷ তবে বেসরকারি হিসাব এরচেয়ে বেশি কিছু হবে বলে মনে হয় না৷ কারণ কেউ আক্রান্ত হলে কিংবা কেউ মরে গেলে, দেশে রোগটি নিয়ে এখন যে আতঙ্ক, তাতে খুব সহজে তা গোপন করা যাবে বলে মনে হয় না৷ 

রোগী নেই, তাহলে মাস্ক পরার এই হুজুগটা কেন? এর একটাই কারণ, আর সেটা হচ্ছে অজ্ঞতা৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো জানেই না, এই রোগটা আসলে কি? কেন হয়, কিভাবে হয়, হলে কি করতে হয়? তবে মুখে মুখে যে বিষয়টা খুবই ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা হচ্ছে- এ রোগের কোন প্রতিষেধক নেই, এ রোগের কোন চিকিৎসাও নেই৷ আর এ কারণেই প্রবল আতঙ্ক৷ আতঙ্কটা হয়তো অমূলক নয়, কিন্তু তাই বলে কি এর কারণে আমাদের জীবনযাত্রাই পাল্টে যাবে? মানুষ কি তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যহত করে ঘরে বসে থাকবে? তাতো আর সম্ভব নয়৷ গরীব দেশের ততোধিক গরীব মানুষ আমরা৷ দিন আনি, দিন খাই৷ একদিন বের না হলে সংসার চলবে কি করে৷ আতঙ্কের কারণে ক্ষুধা তো আর থেমে থাকবে না৷ তখন কি সরকার এই গরীব মানুষদের রুটি-রুজিতে কোন সাহায্য করবে? নাকি কিভাবে কনুই তুলে হাঁচি কাশি দিতে হবে, তা দেখানোর মাধ্যমেই মন্ত্রীগণ তাদের দায়িত্ব সারবেন? 

 করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ নতুন রোগ৷ আবার এমনও নয়, এটা কোন মৌসুমী রোগ, দিন কতক পরেই চলে যাবে৷ একবার যখন এসেছে, হয়তো থেকেই যাবে৷ মানুষ চেষ্টা করছে, হয়তো একে নিয়ন্ত্রণের উপায়ও খুঁজে পাবে৷ কিন্তু রোগটি শিগগিরই চলে যাবে বলে মনে হয় না৷ এইচআইভি, সার্স, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ডেঙ্গু- এই সব ভাইরাসের মতো এটিও হয়তো থেকে যাবে৷ আবার কে জানে, হয়তো স্মলপক্স ভাইরাসের মতো এটিকেও নির্মূল করা সম্ভব হবে৷ এ সবই ভবিষ্যতের কথা৷ কিন্তু বর্তমানের আতঙ্ককে দূর করবেন কি করে? আসলে আতঙ্ক একেবারে দূর হওয়ার নয়, সে চেষ্টাতে যাওয়ারও কোন দরকার নেই৷ বরং চেষ্টা থাকা দরকার আতঙ্ককে নিয়ন্ত্রণের, অপ্রয়োজনীয় আতংককে পরিহারের৷ বাড়তি আতঙ্ক কোন কাজের বিষয় নয়, তা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ক্ষতিগ্রস্থ করে৷ আর সে জন্যই দরকার সচেতনতার৷ জানা থাকা দরকার- কাকে আমরা ভয় পাচ্ছি, এ থেকে বাঁচতে কি আমরা করতে পারি৷ অথবা নতুন এই শত্রুকে আসলে কতটা ভয় পাওয়া দরকার৷ 

এই যে প্রত্যাশিত সচেতনতা, সেটা কিন্তু ততটা নেই সাধারণ মানুষের মধ্যে৷ নেই কেন? নেই এ কারণে যে, সঠিক তথ্যগুলো মানুষের মধ্যে সেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি৷ দায়িত্বটা প্রধানত সরকারের৷ সরকার সে কাজটি সেভাবে করতে পারেনি৷ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একটা শাখা অবশ্য প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলন করেছে৷ সে খবর পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিতও হয়েছে৷ কিন্তু দেশের কতজন মানুষ এখন নিয়মিত পত্রিকা পড়েন? টেলিভিশনেও টুকটাক দেখাচ্ছে৷ কিন্তু বিশ্বাসহীনতার কারণে টিভি সংবাদের প্রতিও তো মানুষের ততটা আগ্রহ আর নেই৷ এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মানুষ সম্পৃক্ত থাকেন সোশ্যাল মিডিয়াতে৷ এখানে সরকারী উদ্যোগে নিয়মিত সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন থাকতে পারতো৷ অথবা প্রতিদিন মোবাইলে করোনা ভাইরাস বিষয়ক বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য দেয়া যেত৷ প্রচলিত পদ্ধতির প্রচারের চেয়ে অনেক কম খরচেই এটা করা সম্ভব হতো৷ ডিজিটাল বাংলাদেশের এনালগ আমলাতন্ত্র এসব পদ্ধতির কথা ভাবছে না৷

সরকার হটলাইন অবশ্য চালু করেছে৷ কিন্তু সেটা কোন শর্টকোডের মাধ্যমে হয়নি৷ বাংললিংকের গোটা কয়েক প্রচলিত নাম্বার দেওয়া হয়েছে৷ প্রথমে ছিল মাত্র চারটা নাম্বার, পরে নাকি আরও গোটা বার নাম্বার দেওয়া হয়েছে৷ ষোল কোটি মানুষের জন্য ১৬টি নাম্বার! একটা বেশিই কম হয়ে গেল না কি? ফলে কেউ ফোন করলে বেশিরভাগ সময়ই এনগেজড পাচ্ছেন৷ গণমানুষের মধ্যে প্রত্যাশিত সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারি এমন উদ্যোগকে অপ্রতুল বলাই যায়৷ অথচ এই মুহূর্তে সরকারের তো এটাই প্রধানতম দায়িত্ব ছিল৷ কোভিড-১৯ এর কোন প্রতিষেধক নেই, তাই আগে থেকে যে নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেয়া হবে- সে সুযোগ নেই৷ এর কোন চিকিৎসা জানা নেই, তাই রোগটির প্রকোপ শুরু হলে যে চিকিৎসা দেওয়া হবে, তার পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখারও কোন প্রশ্ন ওঠছে না৷ তাহলে এই মুহূর্তে করণীয় কি? করণীয় একটাই, তা হচ্ছে- সকল স্তরের মানুষের মধ্যে নতুন এই রোগটি সম্পর্কে পর্যাপ্ত সচেতনতা তৈরি করা৷ মানুষ যেন জানতে পারে তাকে কি করতে হবে, আর কি করা যাবে না৷ সেটা কি হচ্ছে? না, হচ্ছে না৷ যদি হতো তাহলে আর সব মানুষ পাগলের মতো মাস্কের পিছনে দৌড়াতো না৷ সাবান দিয়ে হাত ধুলেই যেখানে চলে, সেখানে তিনচারগুণ দাম দিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনার জন্য মারামারি করতো না৷ 

Masood Kamal
মাসুদ কামাল, সাংবাদিকছবি: Hashibur Reza Kallol

লেখার শুরতে বলছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ার কথা৷ এটা ঘটনা বলি৷ এর মধ্যে একটা মেসেজ পেলাম, একজন একটা পরিসংখ্যান পাঠিয়েছে৷ সেখানে দেখানো হয়েছে ২০২০ সালের প্রথম দুই মাসে পৃথিবীতে কোন রোগে কত মানুষ মারা গেছে৷ হিসাবটা এরকম: ক্যান্সারে ১১ লাখ ৭৭ হাজার ১৪১ জন, ধূমপানে ৭ লাখ ১৬ হাজার ৪৯৮ জন, অতিরিক্ত অ্যালকোহল পানে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ৪৭১ জন,  এইচআইভি'র কারণে ২ লাখ ৪০ হাজার ৯৫০ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৯ জন, আত্মহত্যায় ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯৬ জন, ম্যালেরিয়ায় ১ লাখ ৪০ হাজার ৫৮৪ জন, ফ্লু বা সাধারণ ঠান্ডায় ৬৯ হাজার ৬০২ জন এবং করোনা ভাইরাসে ২ হাজার ৩৬০ জন মারা গেছে৷ সোশ্যাল মিডিয়ার সব তথ্য নাকি বিশ্বাস করতে নেই, যাচাই করে নিতে হয়৷ সে কাজটাও আমি করেছি৷ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে যেয়ে চেক করেছি৷ কোন রোগে বছরে কত মানুষ মারা যায় তার যে হিসাব সেখানে আছে, তাতে সংখ্যার খুব একটা তারতম্য দেখা যায়নি৷ তাহলে দাঁড়ালোটা কি? যে সকল রোগের খুবই ভালো চিকিৎসা আছে, যেমন ম্যালেরিয়া, তাতেও এই দুই মাসে করোনার চেয়ে প্রায় ৬০ গুণ মানুষ বেশি মারা গেছে! সাধারণ যে ফ্লু, যেটা দুনিয়ার সব পরিবারেই কারও না কারও অন্তত একবার করে হয়েছে, সেটিতেও করোনার চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি মানুষ মারা গেছে!

এমন একটা হিসাব জানার পরও কি করোনা নিয়ে মানুষের আতঙ্ক তেমন একটা কমবে? না, কমবে না৷ কারণ ওই একটাই, রোগটি নতুন৷ এর সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত কেউ জানেন না৷ অচেনা আতঙ্ক একটু বেশিই ভীতিকর হয়ে থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এরই মধ্যে জানিয়েছেন, এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে বড়জোর ৩ শতাংশের মত মানুষ মারা যায়৷ তথ্যটি অনেকেই জানেন৷ তারপরও আতঙ্ক কমছে না৷ কমছে না এ কারণে, আক্রান্ত হলে আমি যে ওই তিন শতাংশের মধ্যে থাকব না- সে গ্যারান্টি আমাকে কে দেবে? 

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷ 

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য