করোনায় প্রশ্নের মুখে জনস্বাস্থ্য সচেতনতা
২১ মার্চ ২০২০ভারতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা এই দেশের জনসংখ্যার বিচারে অতি নগণ্য হলেও তার ব্যাপকতা রুখতে সরকারি তরফে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। মার্চের গোড়া থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের পক্ষে সর্বত্র বিশেষ বার্তা প্রচার করা হচ্ছে৷ ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এই প্রচারে মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিচ্ছন্নতায়। হাঁচি-কাশির ক্ষেত্রে মুখে চাপা দেওয়া এবং ঘনঘন হাত ধোয়ার কথা বলা হয়েছে৷ কিন্তু, এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি এত ব্যাপক আকারে প্রচারের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? অনেকের মতে, শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যরক্ষার ন্যূনতম নিয়ম-কানুন মেনে চলার প্রবণতা কম৷ তাই শিয়রে সঙ্কট এসে উপস্থিত হওয়ায় সেটাই বড় করে প্রচার করতে হচ্ছে৷
অথচ কেন্দ্রীয় সরকার গত ৬ বছর ধরে সবচেয়ে বড় যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার কেন্দ্রে রয়েছে পরিচ্ছন্নতার ভাবনা৷ ২০১৪ সাল থেকে কার্যকর হয়েছে স্বচ্ছ ভারত অভিযান প্রকল্প৷ সাধারণ মানুষ যাতে প্রকাশ্যে নিত্যকর্ম না করে তার জন্য গড়ে দেওয়া হচ্ছে শৌচালয়৷ এই অভিযানের মূল ভাবনাই হচ্ছে জনমানসে পরিচ্ছন্নতার ধারণা তৈরি করা, তার গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করা৷ কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর বোঝা যাচ্ছে, এখনো পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব ততটা উপলব্ধি করেনি এই দেশের জনতা৷ তাই হাত ধোয়া ও মুখে চাপা দেওয়ার বার্তা রেল স্টেশন থেকে শুরু করে মোবাইলের কলার টিউনেও জায়গা করে নিয়েছে৷
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের আদলে পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে মিশন নির্মল বাংলা৷ এই প্রকল্পের একই লক্ষ্য, শৌচাগার নির্মাণ করে মানুষকে পরিচ্ছন্নতার দিকে নিয়ে যাওয়া৷ বিশ্ব ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, এটা ভারতের অন্যতম বড় একটি সমস্যা৷ প্রকাশ্যে নিত্যকর্ম করার ফলে কঠিন বর্জ্য মাটি ও জলে মিশে যায়৷ এর থেকে মানবদেহে সংক্রমণ ছড়ায়৷ বিশেষ করে শিশুদের ক্ষতি করে৷
এত সাড়ম্বরে প্রকল্প চলার পরও হাত ধোয়া বা মুখে চাপা দিয়ে হাঁচি-কাশির কথা এত বলতে হচ্ছে কেন? সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম-এর সদস্য, চিকিৎসক স্বপন বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমাদের ব্যক্তিগত স্তরে স্বাস্থ্য সচেতনতা এতই কম যে এটাও বলতে হচ্ছে৷ আমরা যখন গ্রামে রোগী দেখি, তখন অনেক প্রবীণকেও বলতে হয় হাত ধোয়ার কথা। এটা তাঁর শিশু বয়সেই শিখে ফেলা উচিত ছিল৷ এই অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য নিরবচ্ছিন্ন প্রচার দরকার। বিপদ সামনে এসে গেলে প্রচার করে ভালো ফল মেলা মুশকিল৷’’
২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ভারতের ১০ কোটি গ্রামীণ বাড়ি, ১ কোটি শহুরে বাড়িতে শৌচালয় ছিল না৷ স্বচ্ছ ভারত অভিযানে শৌচাগার গড়ে উঠেছে৷ কিন্তু ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, রাজস্থান, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের ৪৪ শতাংশ মানুষের অভ্যাস বদলায়নি৷ শৌচাগার থাকা সত্ত্বেও তারা মাঠেঘাটে, রেললাইনে, নদীর ধারে প্রাতঃকৃত্য করতে যাচ্ছে৷ আবার অনেক ক্ষেত্রে শৌচাগার থাকলেও তা ব্যবহারের উপায় নেই৷ হাসপাতাল ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা সংগঠন-এর যুগ্ম সম্পাদক, চিকিৎসক অংশুমান মিত্র বলেন, ‘‘স্বচ্ছ ভারত নির্মল বাংলা যে শৌচাগার গড়ে তুলেছে তার একটা বড় অংশে জলের জোগান নেই৷ তাই ইচ্ছা থাকলেও শৌচাগার ব্যবহার করা সম্ভব নয়৷ সুতরাং প্রচার হল, কিন্তু জনস্বাস্থ্যের উন্নতি হল না৷ জনসচেতনতা আরো দূরের ব্যাপার৷’’ তাঁর মতে, ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত সচেতনতা পর্যাপ্ত নেই বলে করোনা নিয়ে আতঙ্ক বেশি ছড়াচ্ছে৷ এটা সরকারকে ভাবতে হবে, যাতে একেবারে ছোট বয়স থেকে এই অভ্যাস গড়ে ওঠে৷ অনেকেই বলছেন, সচেতনতা কম বলে উচ্চপদস্থ আমলা তার বিদেশ ফেরত পুত্রকে নিয়ে নবান্নে গিয়েছিলেন৷ তার জেরে খোদ প্রশাসনের সদর দপ্তরে ভাইরাস ছড়িয়েছে!
করোনার সংক্রমণ রুখতে বারবার হাত ধোয়ার কথা বলা হলেও পথচলতি মানুষের কাছে সেই পরিকাঠামো নেই৷ কলকাতা শহরে চলার পথে ঘনঘন হাত ধোয়ার মতো জলের জোগান পাওয়া মুশকিল৷ ইদানীং ‘পে অ্যান্ড ইউজ' টয়লেটের সংখ্যা বাড়লেও জনসংখ্যার অনুপাতে তা পর্যাপ্ত নয়৷ ফলে অনেক জনবহুল রাস্তাযর মোড়ে তৈরি হয়ে গিয়েছে মুক্ত প্রস্রাববখানা৷ সেখান থেকে দুর্গন্ধ ও সংক্রমণ ছড়াচ্ছে৷ সচেতনতা যখন এই স্তরে, তখন হাত ধোয়া ও মুখে চাপা দেওয়ার বার্তা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে বটে৷