কলকাতা কি সাহিত্যের শহর হতে পারে?
৩০ অক্টোবর ২০১৮২০০৪ সাল থেকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেস্কো নানা ক্ষেত্রে সৃজনশীল কাজের জন্য বিখ্যাত শহরের তালিকা তৈরি করতে শুরু করে৷ সেই পরম্পরাতেই ২০১৭ সালে সাহিত্যের শহরের তালিকা প্রস্তুত করে ইউনেস্কো৷ এই তালিকায় ২৭টি শহরের উল্লেখ রয়েছে৷ এই শহরগুলি ৬টি মহাদেশের ২৩টি দেশে৷ তালিকায় যেমন ইংল্যান্ডের নরউইচ, জার্মানির হাইডেলবার্গ, চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ, স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ, অ্যামেরিকার আইওয়া সিটির নাম রয়েছে, তেমনি ঠাঁই পেয়েছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের নাম৷ এই তালিকায় এমন কিছু শহরের নাম নেই, যেখানে ব্যপকভাবে সাহিত্যের চর্চা হয়৷ শুধু তাই নয়, সেই শহরের অধিকাংশ মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, তা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মাতৃভাষা৷
এই প্রসঙ্গে বাংলাভাষা ও কলকাতা শহরের কথা বলতেই হয়৷ ২৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা৷ সেই ভাষায় সাহিত্যচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত কলকাতা৷ অখণ্ড ভারতের রাজধানী কলকাতা উপমহাদেশের প্রথম নোবেল বিজেতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ও কর্মভূমি৷ বিশ্বকবি তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির জন্য নোবেল পেয়েছেন৷ সাহিত্যচর্চার সেই ধারা আজও বহমান৷ তবু কেন কলকাতা ইউনেস্কোর তালিকায় জায়গা পেলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাসাহিত্য ও প্রকাশনা জগতের শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা৷
কবি সুবোধ সরকার ইউনেস্কোর এই সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত৷ এই তালিকা দেখে তিনি দুঃখিত ও বিষণ্ণ৷ এই তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে শুধু সাহিত্যপ্রেম নয়, প্রকাশনা থেকে অনুবাদের কাজ, গ্রন্থাগার থেকে পুস্তকবিপণি, এমন বিভিন্ন মাপকাঠি রাখা হয়েছে৷ এসবে গুরুত্ব না দিয়ে ডয়চে ভেলেকে সুবোধ সরকার বলেন, ‘‘এই শহরে খোলা আকাশের নীচে বৃহত্তম বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়৷ ১০ দিন ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ আসেন বইমেলায়৷ পৃথিবীতে কোথাও এটা হয় না৷ শুধু এই কারণেই কলকাতাকে সাহিত্যের শহরের স্বীকৃতি দেওয়া যেতো৷''
শুধু বইমেলা নয়, কলকাতার পক্ষে আরো যুক্তি দাঁড় করেন সুবোধ সরকার৷ তিনি বলেন, ‘‘যে শহরে ৩ হাজার লিটল ম্যাগাজিন বেরোয়, সেই শহরকে তো ফেলে দেওয়া যায় না৷ কলকাতায় ১০-১৫টা সাহিত্যসভা হয় রোজ৷ এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের শহর সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঘর করে৷''
সাহিত্যের গুণমানের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকা তৈরি হয়নি৷ ইউনেস্কো এই সংক্রান্ত একটি মাপকাঠি তৈরি করেছে৷ সেই মাপকাঠিতে দেখা হয়েছে একটি শহর থেকে কী ধরনের বা কত রকমের বই প্রকাশিত হয়৷ গ্রন্থাগার বা বইয়ের দোকানের সংখ্যা কত৷ বড়মাপের কোনো সাহিত্যের আসর হয় কিনা৷ অনুবাদের কাজ কতটা গুরুত্বের সঙ্গে করা হয়৷ গণমাধ্যম কীভাবে সাহিত্যকে তুলে ধরে৷ এই মাপকাঠিতে কি কলকাতা সত্যিই পিছিয়ে রয়েছে? কলকাতার শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা সংস্থা ‘দেজ পাবলিশিং'-এর কর্তা অপু দে মনে করেন, কলকাতার এই তলিকায় থাকা উচিত ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘শুধু সাহিত্য নয়, প্রকাশনার নিরিখেও কলকাতা অনেকের থেকেই এগিয়ে৷ বিপুল সংখ্যায় বই পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়৷ এ সঙ্গে রয়েছে শারদীয়া সাহিত্যের প্রকাশ৷ তা-ও কেন ইউনেস্কো কলকাতাকে বঞ্চিত করল জানি না৷ তবে এতে বইপ্রেমীদের কিছু যায় আসে না৷ কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া সবার কাছে দর্শনীয়৷ এর কোনো বিকল্প নেই৷''
তবে অপু জানান, বাংলা ভাষায় মৌলিক রচনা প্রকাশের তুলনায় অনুবাদ সাহিত্য কলকাতায় কম গুরুত্ব পায়৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘আধুনিক সাহিত্যের অনুবাদ তুলনায় কম হয়, আসলে বাঙালিরা মূল ভাষাতেই সাহিত্য পড়তে পছন্দ করেন৷ অনুবাদে নয়৷ ঝুম্পা লাহিড়ি বা অমিতাভ ঘোষের অনুবাদের বদলে মূল বইটি পড়তে চান৷ সাহিত্যচর্চায় এগিয়ে না থাকলে এটা সম্ভব নয়৷''
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক রতন কুমার নন্দী কলকাতার প্রকাশনার ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘উনিশ শতকের গোড়া থেকে কলকাতায় সাহিত্যের বই প্রকাশের শুরু৷ তার ধারাবাহিকতাতেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্ভব৷ শুধু বইপ্রকাশ নয়, এই নিয়ে সারা বছর আলোচনা চলে৷ আমরা পরিষদে বছরে ৩৪ থেকে ৩৬টি আলোচনা সভা করি৷ এশিয়াটিক সোসাইটি ও সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সিরিয়াস চর্চা হয়৷ এছাড়া অগুনতি ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান তো রয়েছে, যারা সাহিত্যসভা করে৷''
বিশ্বায়নের পর দুনিয়া জুড়ে গণমাধ্যমের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে৷ এখন বিনোদন বেশি গুরুত্ব পায়৷ এর মধ্যেও কলকাতার সরকারি গণমাধ্যমে সাহিত্যনির্ভর অনুষ্ঠান অনেকটা জায়গা জুড়েই থাকে৷ আকাশবাণী কলকাতার প্রাক্তন সহ-অধিকর্তা সৌমেন বসু বলেন, ‘‘এখনকার প্রজন্ম ততটা সাহিত্যমুখী নয়৷ তবু সাহিত্যের চর্চা আকাশবাণী বজায় রেখেছে৷ শ্রবণী-র মতো বেতার সাহিত্য পত্রিকা প্রচারিত হয়৷ কবিতা ও গল্পপাঠের আসর শোনা যায়৷ প্রতিশ্রুতিমান সাহিত্যিকদের দিয়ে অনুষ্ঠান করানো হয়৷ সাহিত্যনির্ভর নাটকের বিপুল সম্ভার রয়েছে৷ অন্য ভাষার নাটক বাংলায় অনুবাদ করে প্রচার করা হয়৷ আকাশবাণীর আন্তর্জাতিক মৈত্রী চ্যানেলে ভারত ও বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা নিয়মিত সাহিত্যচর্চা করেন৷''
তাই তাঁর বিস্ময়, ‘‘আমি জানি না ইউনেস্কো কোন মাপকাঠিতে কলকাতাকে বাদ দিলো৷ এখন কলকাতার সাহিত্যিকরা নিয়মিত বিদেশে যাচ্ছেন সাহিত্যসভায় যোগ দিতে৷ এটা ইউনেস্কোর জানা উচিত৷''
অনেকেই মনে করেন, কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক দশকে যে গ্রন্থাগার আন্দোলন হয়েছে, তা অনন্যতার দাবি রাখে৷ কলকাতা থেকে জেলায় গড়ে উঠেছে অজস্র গ্রন্থাগার, যার একটা বড় অংশ সরকারের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় চলে৷ এই মুহূর্তে এ রাজ্যে প্রায় আড়াই হাজার গ্রন্থাগার রয়েছে৷ এটাই প্রমাণ করে এই গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে কলকাতাসহ বাংলায় সাহিত্যের চর্চা কতটা প্রাণবন্ত৷
কলকাতাবাসীদের এই চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে রামমোহন সরণির চালতাবাগানের পুজোর থিমেই এবার উঠে এসেছিল বিষয়টি৷ তাঁদের বক্তব্য, জেমস জয়েসের ডাবলিন যদি সাহিত্যের শহর হতে পারে, তবে কবিগুরুর কলকাতা নয় কেন? ইউনেস্কোর দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল তাঁদের মূল লক্ষ্য৷
শুধু তথ্য পরিসংখ্যান নয়, সাহিত্যের সঙ্গে এই প্রাণের যোগকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন কবি সুবোধ সরকার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এই তথ্যের বাইরে মন-মনন বলে একটা কথা আছে৷ যে কারণে কলকাতা সারা দেশে সাহিত্য- সংস্কৃতির আইকন৷ তাই কলকাতার ইউনেস্কোর তালিকায় আসাই উচিত৷''