কেন গৃহকর্মী নির্যাতন?
২১ অক্টোবর ২০১৫গৃহকর্মীরা নানা ধরণের শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ও শোষণের শিকার হয়৷ ক্ষেত্রবিশেষে পাচারের ঘটনাও ঘটে৷ প্রতিনিয়ত চড়-থাপ্পর, লাথি-ঘুসি, পর্যাপ্ত খাবার খেতে এবং ঘুমোতে না দেওয়ার মতো শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে অহরহ৷ অন্যদিকে, অকথ্য ভাষায় বকাঝকা, বিভিন্ন নামে ডাকা, বংশ পরিচয় নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবহেলা করা ইত্যাদি মানসিক নির্যাতন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ এছাড়াও ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনাও ঘটছে, এমনকি নির্যাতনের ফলে হচ্ছে মৃত্যুও৷ অনেকে আত্মহত্যার করছে৷ অল্প-বয়সি মেয়ে শিশুরা মূলত নির্যাতনের শিকার হলেও, ছেলে শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য৷
কী কারণে একজন ব্যক্তি নির্যাতনকারী হয়ে ওঠে? গৃহকর্মী নির্যাতনকারীরা কি কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, বিশেষ শ্রেণি বা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত? নির্যাতনকারীর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাই বা কী রকম? আমার কাছে প্রশ্ন এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন৷
প্রতিটি মানুষের মাঝে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক – দু'টি সত্তাই বাস করে৷ যার মধ্যে যে সত্তার পরিচর্যা বেশি হয়, তাঁর আচরণে সেই সত্তাটি প্রকট হয়ে ওঠে৷ অপরাধ করার পর যদি অপরাধীর বিচার না হয়, তাহলে সেই নেতিবাচক সত্তাটি ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷ সামান্য নির্যাতন থেকে ভয়ংকর খুন-খারাবিও তখন করে বসে তারা৷ গৃহকর্মী নির্যাতন সেরকম একটি অপরাধ যার জন্য বিচারের ঘটনা খুবই অপ্রতুল৷ মানুষ ধরেই নেয়, গৃহকর্মীকে নির্যাতন করা কোনো ব্যাপার না৷
বিচারহীনতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ আরেকটি বিষয় মানুষকে অপরাধ করতে প্রলুব্ধ করে৷ সেটা হলো দুর্বল টার্গেট৷ বাংলা প্রবাদটি মনে আছে – শক্তের ভক্ত, নরমের জম? হ্যাঁ, গৃহকর্মীরা প্রতিপক্ষ হিসেবে খুবই নরম৷ নির্যাতনকারীকে প্রতিহত করার শারীরিক, মানসিক বা আইনি সামর্থ্য তাদের নেই৷ আর এই বিষয়টা নির্যাতনকারীরা ভালোভাবেই জানে৷ ফলে চলতেই থাকে শোষণ৷
উল্লিখিত দুই কারণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবতা৷ তাহলে তো সব গৃহকর্মীই নির্যাতনের শিকার হতো৷ তাই কি হয়? অনেক পরিবারে গৃহকর্মীরা স্বাচ্ছন্দে কাজ করে৷ হ্যাঁ, এইখানে লুকিয়ে আছে নির্যাতনকারীর বৈশিষ্ট্যের বিষয়টা৷ একজনের শৈশবকালীন অভিজ্ঞতা তাঁর পরবর্তী আচরণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে৷ শৈশবকালে কেউ নির্যাতনের শিকার হলে তাঁর নির্যাতনকারী হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকে৷ একজন শিশু চোখের সামনে অন্য একজনকে নিয়মিত নির্যাতিত হতে দেখলে সে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক মনে করতে পারে৷ কলহ, বিবাদ, মাদকাসক্ত বা অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশুরা পরবর্তীতে নিজেরাই নির্যাতনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে৷
শৈশবকালীন নেতিবাচক অভিজ্ঞতা যেমন বর্তমান আচরণকে প্রভাবিত করে, তেমনি প্রাপ্ত বয়সে যথার্থ পরিচর্যার মাধ্যমে তাঁর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস করাও সম্ভব৷ অর্থাৎ ব্যক্তির বর্তমান মানসিক অবস্থাও গুরুত্বপুর্ণ তাঁর আচরণ বহিঃপ্রকাশে৷ ব্যক্তি যদি মানসিক অস্থিরতা বা অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে যায়, তাঁর কাছে স্বাভাবিক আচরণ আশা করা কঠিন৷ যেমন বিষণ্ণতা, হতাশা, চাপ, উদ্বেগ, ভয়, শুচিবায়ু, সামাজিক দক্ষতার ঘাটতি, মাদকাসক্তি, শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি নানা জটিলতায় আক্রান্ত ব্যক্তি তুচ্ছ কারণে গৃহকর্মীকে নির্যাতন করতে পারে৷
ক্ষেত্রবিশেষে কিছু ভ্রান্ত ধারণা একজনকে নির্যাতন চালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে৷ যেমন ‘সঠিকভাবে কাজ করাতে হলে মার দিতে হবে, দু-চারটা চড় থাপ্পড়ে কী আসে যায়, কাজের লোকের সাথে ধমকের সুরে কথা বলতে হবে, গৃহকর্তা/গৃহকর্তী হিসেবে তাকে মারধোর করার অধিকার আমার আছে, কাজের লোককে আলাদা ভাবে দেখতে হবে', ইত্যাদি ভ্রান্ত বিশ্বাস ব্যক্তিকে নির্যাতন করার ‘লাইসেন্স' দেয়৷
গৃহকর্মী নির্যাতন একটি অপরাধ; স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘন৷ গৃহকর্মীর সুরক্ষার জন্য যথাযথ আইনি ব্যবস্থা প্রণয়নে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন৷ সমাজের একটি বৃহৎ অংশকে অবহেলা করে কীভাবে আমরা নিজেরা স্বাচ্ছন্দে থাকাতে পারি? আপনার বাসায় যদি গৃহকর্মী নির্যাতন বা অবহেলার শিকার হয়, তবে সেটা হবে আপনার দ্বারা আপনার সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় অমঙ্গলের কাজ৷
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷