কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত নিরসনে সুপ্রিম কোর্টের রায়
৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯রায়ে বলা হয়, কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে সারদা চিট ফান্ড তদন্তের কাজে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠালে তাঁকে হাজির হাজির হতে হবে৷ তবে সিবিআই তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না৷
গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ-র নেতৃত্বে তিন বিচারকের বেঞ্চ সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্তে রায় দেন যে, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠালে তাঁকে হাজির থাকতে হবে৷ তবে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যাবে না৷ তদন্ত প্রক্রিয়ায় পুলিশ কমিশনারকে সিবিআই-এর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে৷ তদন্তের নিরপেক্ষতার স্বার্থে জেরা করা হবে কলকাতা বা দিল্লিতে নয়, মেঘালয়ের শিলংয়ে৷
ধর্নামঞ্চ থেকেই মমতা বন্দোপাধ্যায় এই রায়কে তাঁদের নৈতিক জয় বলে দাবি করে বলেছেন, রাজীব কুমার কখনোই বলেননি, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি হাজির থাকবেন না৷ সিবিআই আধিকারিকরা পুলিশ কমিশনারের বাসভবনে গিয়েছিল তাঁকে গ্রেপ্তার করতে৷ মমতার কথায়, ‘‘বন্দুক বা গো-রক্ষা দিয়ে দেশ চালানো যায় না৷ এই রায় দেশের গণতন্ত্র এবং সংবিধানের জয়৷ দেশের বিচারবিভাগের ওপর তাঁর আস্থা আছে৷ মোদী সরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করতেই এটা করছে৷ এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা৷''
অনেক বিজেপিবিরোধী দলকে মমতা বন্দোপাধ্যায় পাশে পান৷ মোদীবিরোধী ঐক্য খানিকটা মজবুত হয়৷ মমতার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু৷ পরে মমতা তাঁর ৪৮ ঘন্টার ধর্না তুলে নেন৷
অপরদিকে সিবিআই-এর পাল্টা বক্তব্য, গত রবিবার কলকাতা পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই সিবিআই অফিসাররা পুলিশ কমিশনারের বাসভবনে যেতে গেলে স্থানীয় পুলিশ তাঁদের বাধা দেয়, চরম হেনস্থা করে এবং জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে থানায় আটকে রাখে৷ এর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং পুলিশ কমিশনারের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন৷ প্রশ্ন উঠেছে, মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ কমিশনারের বাড়িতে যাবার কী দরকার? পুলিশ কমিশনারকে ডেকে পাঠালেই তো হতো৷ বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয়ই কোনো গূঢ় কারণ আছে৷ সিবিআই-এর অভিযোগ পুলিশ কমিশনারের কাছে যেসব তথ্য প্রমাণ আছে, তা লোপাট করা৷
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে সারদা কেলেঙ্কারি যখন ফাঁস হয়, তখন বর্তমান পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল সিট-এর তদন্ত শুরু হয়৷বেশ কিছু নথি তিনি সিবিআইকে দেননি৷
পরে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে সেই তদন্তের ভার নেয় সিবিআই৷ রাজীব কুমারকে বারংবার নোটিশ পাঠানো হলেও তিনি আসেননি৷ দ্বিতীয়ত, মমতার রাজনৈতিক ধর্নামঞ্চে পুলিশ কমিশনারের যোগ দেওয়াটা কি সংবিধানসম্মত ? যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাইপো অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের বসার কথা, সেখানে বসলেন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার? কেন ধর্নামঞ্চে একটিবারও দেখা গেল না অভিষেক বন্দোপাধ্যায়কে? কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো এই তদন্ত হাতে নিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই৷ সেক্ষেত্রে তদন্ত কাজের সূত্রে কাউকে জেরা করতে না দেওয়াটা আদালত অবমাননা করা৷ এই মর্মে সিবিআই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করেছে৷ তথ্যপ্রমাণ লোপাট এবং আদালত অবমাননা মামলার শুনানি হবে আগামী ২০শে ফেব্রুয়ারি৷
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কোন পক্ষের জিত হলো সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. অমল মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালত পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন তদন্ত কাজে সিবিআই-এর সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে৷ পুলিশ কমিশনারকে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে৷ পাছে কোনো বিতর্ক না হয়, পশ্চিমবঙ্গে হলে রাজ্য সরকার যাতে কোনোরকম বাধা সৃষ্টি করতে না পারে৷ তাই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে শিলংয়ে৷ দ্বিতীয় কথা, মহামান্য আদালত বলেছেন, পুলিশ কমিশনারের বিরুদ্ধে নিগ্রহমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না৷ সিবিআই পুলিশ কমিশনারের বাসভবনে গিয়েছিলেন জিজ্ঞাসাবাদ করতে৷ গ্রেপ্তার করতে নয়৷ গ্রেপ্তার তখনই করতে পারবে, যখন যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ সিবিআই-এর হাতে আসবে৷''
পক্ষান্তরে আরো একটি মামলা হয়েছে আদালত অবমাননার৷ এই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে সিবিআইকে বলেছিলেন খোদ সুপ্রিম কোর্ট৷ সেই কাজে রাজ্য সরকার বাধা সৃষ্টি করেছে৷ তাই সুপ্রিম কোর্ট পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব, পুলিশের মহাঅধিকর্তা এবং পুলিশ কমিশনারের কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন৷ ১৮ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাঁদের হলফনামা দাখিল করতে হবে৷ পরবর্তী শুনানিতে দরকার হলে তাঁদের তিনজনকে সশরীরে আদালতে হাজির থাকতে হবে৷ কাজেই সুপ্রিম কোর্ট তদন্তের কাজটা সহজ করে দিয়েছেন৷ তবে এই রায়ে কার জয়, কার পরাজয় সেটা জনগণই বিচার করবে'', ডয়চে ভেলেকে বললেন রাষ্ট্র বিজ্ঞানি ড. অমল মুখোপাধ্যায়৷
বিজেপির সর্বভারতীয় জেনারেল সেক্রেটারি কৈলাস বিজয়বর্গীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ‘‘এটা ভারতের গণতন্ত্র ও সংবিধানের জয়৷ মমতা বন্দাপাধ্যায়ের উচিত এই রায়ের পর পদত্যাগ করা৷'' পশ্চিমবঙ্গের মমতা প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো, তথা মোদী সরকারের সংঘাতের ঝাপটা এসে পড়ে সংসদেও৷ মঙ্গলবার সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার অধিবেশন এই নিয়ে দ্বিতীয় দিনেও পন্ড হয়ে যায় বিরোধীপক্ষের শোরগোলে৷ অধিবেশন শুরু হতে না হতেই তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি এবং কংগ্রেস সদস্যরা ‘সংবিধান বাঁচাও, দেশ বাঁচাও' শ্লোগাল তুলতে তুলতে অধ্যক্ষের মঞ্চের দিকে ধেয়ে যান৷