কীভাবে নিষিদ্ধ হবে জামাত?
৪ অক্টোবর ২০১৬‘‘তবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হলে প্রথমেই একটা আইন করতে হবে'' – ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধকরণের ব্যাপারে এমনটাই বলেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা৷
ডয়চে ভেলে: জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার কথা অনেক দিন ধরেই হচ্ছে৷ অথচ এত কিছুর পরও কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না?
মাহবুবে আলম: যাচ্ছে যে না, তা নয়৷ তবে নিষিদ্ধ করতে হলে একটা আইন তো করতে হবে৷ সেটা পৃথক একটা আইন হতে পারে অথবা যুদ্ধাপরাধী সংক্রান্ত যে আইনগুলো হচ্ছে, সে আইনের মাধ্যমেও হতে পারে৷ তবে আগে আইনটা করতে হবে৷ এরা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত৷ তাদের সব ধরনের কর্মকাণ্ড, ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড – এ সবকিছু নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রাষ্ট্রকে দেবে আইন৷ সেই আইনটা না হওয়া পর্যন্ত এটা করা যাচ্ছে না৷
আমরা জানি জামায়াত নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটা আইন আলোচনায় আছে৷ সেটার কতদূর অগ্রগতি হয়েছে?
এই মুহূর্তে সেটার অবস্থা কী, তা বলা কষ্টকর৷
জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে হাইকোর্টের একটা রায় আছে৷ তা আপিল বিভাগে কি এটা শুনানির জন্য এসেছে?
এখন পর্যন্ত আসেনি৷
এ ব্যাপারে আপনাদের উদ্যোগ কী?
আদালতে বর্তমানে অবকাশকালীন ছুটি চলছে৷ খুলবে অক্টোবরের শেষ তারিখে৷ কোর্ট খুললে আমরা খোঁজ-খবর নিয়ে দেখব যে, এটা শুনানির জন্য ‘রেডি' হয়েছে কিনা৷ তারপর যথাযথ পদক্ষেপগুলো নেবো৷
জামায়াত তো দলগতভাবে নির্বাচনে অযোগ্য৷ আমরা দেখেছি, ব্যক্তি পর্যায়ে জামায়াত নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন এবং কেউ কেউ নির্বাচিতও হচ্ছেন৷ জামায়াত নেতাদের নির্বাচনে নিষিদ্ধ করা বা তাঁদের নির্বাচনের বাইরে রাখার ব্যাপারে আপনাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা আছে কি?
সেটা করতে হলে দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে৷ শুধু একজন ব্যক্তিকে তো এভাবে নিষিদ্ধ করলে কোনো লাভ হবে না৷ আইন করে দলকে আগে নিষিদ্ধ করতে হবে৷ তাহলেই তার ‘এফেক্ট' সবার ওপর বর্তাবে৷
জামায়াত তো নির্বাচনে নিষিদ্ধ হয়েছে৷ তা তাদের কর্তা-ব্যক্তি যাঁরা আছেন, তাঁদের ব্যাপারে কোনো চিন্তা আছে কি?
কোনো নেতা যদি তাঁর পার্টির প্রতীক নিয়ে দাঁড়ায়, তখন পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্ন আসবে৷ এখন তো অনেকটা লুকোচুরির মতো অবস্থা৷ নিজেদের ‘আইডিওলজি' গোপন করে তাঁরা বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নিচ্ছে৷
আমরা জানি, জামায়াত আর্থিকভাবে খুবই শক্তিশালী জায়গায় আছে৷ জামায়াতের অনেক বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানও আছে৷ এগুলো নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই?
প্রথমেই তো বললাম, এ ব্যাপারে আইন না করে কিছু করা যাচ্ছে না৷ আমাদের দেশ একটা সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক দেশ৷ আমাদের সংবিধানে অনেকগুলো স্বাধীনতা সংরক্ষণ করা আছে৷ সেক্ষেত্রে আইন না করে এটা করা খুবই কঠিন ব্যাপার৷ তাই আগে আইন করতে হবে৷
একদিকে আমরা দেখছি, জামায়াতের ব্যাপারে সরকারের নেতিবাচক চিন্তা-ভাবনা৷ অন্যদিকে জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আমরা সরকারকে কখনও কখনও সহযোগিতাও নিতে দেখি....এ বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
এটা কিন্তু ঠিক না৷ একটা সময় ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে বা বিভিন্ন খেলার ব্যাপারে জামায়াত নানারকম বিজ্ঞাপন দিতো৷ সেটা নিয়ে তখন খুব সমালোচনা হয়েছিল৷ তবে একবারই এমন হয়েছিল৷ এরপর আর এটা দেখিনি৷ অবশ্য সেটাও জামায়াত সরাসরি করেনি৷ ইসলামী ব্যাংক কতগুলো ব্যাপারে অংশ নিয়েছিল৷ জনশ্রুতি আছে, ইসলামী ব্যাংক জামায়াতের৷ ইসলামী ব্যাংকের বোর্ড অফ ডিরেক্টরে তো এখন পরিবর্তন ঘটেছে৷ এখন সেখানে অনেক ডিরেক্টর আছেন, যাঁরা সরকারের বিভিন্ন পদে আসীন৷
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে আপনার পরামর্শ কী?
আইন সংশোধন করা৷ যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত যে দল বা ব্যক্তি বা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান, তারা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না – এই মর্মে স্পষ্ট একটা আইন করতে হবে৷
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে অনেকগুলো রায়ে এই প্রসঙ্গটি এসেছে৷ সেক্ষেত্রে আপনাদের নতুন করে কোনো ভাবনার জায়গা তৈরি হয়েছে কি?
আমি যে কথা প্রথম থেকেই বলছি, একটা আইন করতে হবে৷ এই আইন করবে আমাদের সংসদ৷ আর সরকার এ ব্যাপারে একটা নীতি গ্রহণ করবে৷ প্রশ্ন হলো, সেটা কবে করবে বা আদৌ করবে কিনা, তা নিয়ে৷
এই মুহূর্তে সরকারের কী করণীয়? সে ব্যাপারে আপনার যদি কোনো পরামর্শ থাকে...
এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত৷ এটা করলে কি সরকার লাভবান হবে? এতে কি গণতন্ত্রের মঙ্গল হবে? না এই সমস্ত দলগুলো আবারো ভিন্ন নামে তাদের কর্মকাণ্ড শুরু করার সুযোগ পাবে? এ রকম নানা বিষয় আছে৷ আসলে এটা ‘স্ট্র্যাটেজির' প্রশ্ন এবং নিশ্চয় সরকারের বিবেচনাধীন৷
আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের যে তৎপরতা আমরা দেখছি বা যারা ধরা পড়ছে, তাদের মধ্যেও অনেক জামায়াত-শিবিরের নেতা রয়েছে৷ তাদের ব্যাপারে গোয়েন্দাদের কাছে কি তথ্য রয়েছে?
হ্যাঁ, এ ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে৷ এই দলে যে ট্রেনিং হতো, নানারকম নির্জন জায়গায় যে তাদের সভা-সমাবেশ হতো, সেখানে অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং দেয়া হতো – এমন খবর আজকে থেকে ১০-১২ বছর আগে থেকেই সংবাদমাধ্যমে আসছে৷ জামায়াতের পক্ষ থেকেও এগুলো কখনও সরাসরি অস্বীকার করা হয়নি৷
২০০৯ সালের শুরুতে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে৷ অর্থাৎ প্রায় সাত বছর পার হয়ে গেল৷ তারপরও কেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে পারছে না?
না, এখানে না পারার প্রশ্ন না৷ ব্যাপারটা হলো স্ট্যাটেজির বা কৌশলগত৷ আজকে যদি জামায়াতকে আপনি নিষিদ্ধ করেন, তাহলে তারা অন্য নামে, অন্যান্য দলের সঙ্গে মিশে তাদের শক্তিটা আরো বৃদ্ধি করতে পারে৷ এই জিনিসগুলো হয়ত বিবেচনায় নিচ্ছে সরকার৷ আমি যতখানি বুঝি, তাদের যে কর্মকাণ্ড, যে আইডিওলজিতে তারা বিশ্বাস করে, সেটা শুধু নাম বন্ধ করে হবে না৷ নামটা বন্ধ করে দিলাম, কিন্তু অন্য কোনো নামে তাদের আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ থাকবে কিনা এবং সেক্ষেত্রে কী করা হবে? এ ধরনের প্রশ্ন আগেই যাচাই করে দেখতে হবে৷
যেমন ধরুন, লাদেনের দলকে যখন ‘ব্যান' করা হলো – তখন আমরা জানতাম যে একজন সন্ত্রাসী ইসলামের নাম ব্যবহার করে নানারকম কাজ করছে৷ লাদেনদের দমন করার জন্য নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলো৷ অথচ এর পরেই দেখুন ‘ইসলামিক স্টেট' তৈরি হয়ে গেল৷ এই ইসলামিক স্টেট তো লাদেনদের চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং অনেক বেশি৷ কাজেই শুধু নামের ব্যাপারে যদি একটা নিষেধাজ্ঞা দেন, তাহলে হবে না৷ ভেতর থেকে এদের আইডিওলজিক্যাল যে শক্তি আছে, সেটা প্রতিহত করতে হবে৷ নিশ্চয় সরকার এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করছে৷ সরকার যে তাদের নির্বিঘ্নে কাজ করতে দেবে বা দিচ্ছে, সে কথা ঠিক না৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, যারা মৌলবাদে বিশ্বাস করে, যারা মনে করে ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করা প্রয়োজন, যাদের ‘টার্গেট' হলো ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন করা, তাদের ‘আইডেন্টিফাই' না করলে কোনো ফল হবে না৷ ফলে আজকে তাদের নিষিদ্ধ করলে, তারা যদি অন্য নামে শুরু করে দেয়, অন্য নতুন লোকদের ‘রিক্রুট' করে, তখন তো পরিস্থিতি আরো বিপদজ্জনক হবে৷ তাই না? তবে এ সমস্ত জিনিস বিবেচনায় নিয়েই সরকার এগোচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷