ক্ষুধা সূচকেও বাংলাদেশের নীচে কেন ভারত
১৯ অক্টোবর ২০২০পর পর দুইটি সূচকে প্রতিবেশী বাংলাদেশের থেকেও নীচে নেমে গেলো ভারত। দিন কয়েক আগে আইএমএফের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, ২০২০ সালে বংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ভারতের থেকে ১১ ডলার এগিয়ে যাবে। তারপর ভারতের জন্য এসেছে আরো একটি ধাক্কা। ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার ইনডেক্স বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান সহ সব প্রতিবেশী দেশের থেকে নীচে নেমে গেছে ভারত। ভারতের নীচে আছে মূলত আফ্রিকার হতদরিদ্র দেশগুলি, ক্ষুধা যাদের নিত্যসঙ্গী।
কিন্তু ভারত যেখানে আর্থিক মহাশক্তি হতে চাইছে, ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সমানে উন্নয়নের খতিয়ান দিতে ব্যস্ত, প্রধানমন্ত্রী মোদী বারবার দাবি করেন, গত ৬০ বছরে যে কাজ হয়নি, তা তিনি ছয় বছরে করে ফেলেছেন, সেখানে ক্ষুধা সূচকে কেন নামবে ভারত? কেনই বা একপেট খিদে নিয়ে শুতে যাবেন বিপুল সংখ্যক মানুষ?
ক্ষুধাসূচকের রিপোর্ট আসার পর তাই নতুন করে হইচই শুরু হয়েছে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''গত কিছুদিন ধরে যে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তাতে এরকম একটা আশঙ্কা ছিল। যে ভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মূর্তি তৈরি হয়েছে, রামমন্দির তৈরি হচ্ছে, প্রতিবেশীর সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, তাতে গরিব মানুষ ও খাবারের দিকে সরকারের যে নজর নেই, তা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, এই রিপোর্ট তা স্পষ্ট করে দিল।''
পবিত্রবাবু মনে করেন, মুসকিল হলো, ''যে মানুষদের নিয়ে এই রিপোর্ট, তাঁরা এই সব তথ্য জানতে পারেন না। ভোটের সময় অন্য বিষয়ের ভিত্তিতে তাঁরা সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। আমাদের দেশের ভিতর দুইটি দেশ আছে, ইন্ডিয়া ও ভারত। ইন্ডিয়ার জাঁকজমক সকলের সামনে তুলে ধরা হয়। ভারতের ক্ষুধা সকলের সামনে আসে না।''
পবিত্রবাবুর একটি কথা ঠিক। গরিব মানুষরা জানেনই না ক্ষুধা সূচক বলে একটা ব্যাপার আছে। তাতে ভারত ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করেন সন্ধ্যা। ক্ষুধা সূচকের কথা তুলতেই সন্ধ্যা আকাশ থেকে পড়েন। বলেন, ''সেটা কী গো।'' একটু বুঝিয়ে বলার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া, ''আমাদের আর ও সব জেনে কী হবে। বাজার আগুন। সবজি ছোঁয়া যাচ্ছে না। এক কেজি ডাল ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ওই সব পুষ্টিকর খাবারের বিলাসিতা আমাদের চলে না।'' একই কথা প্লাস্টিকের প্যাকেট দোকানে পৌঁছে দিয়ে সংসার চালানো দেবুর। দু-বেলা খাবার, বাচ্চাদের স্কুলের জামা, যাতায়াত সহ খরচ কুলানো যাচ্ছে না। ফলে খাবারে টান পড়েই।
কিন্তু এই অবস্থা তো হওয়ার কথা নয়। প্রতি বছর ভারতে যা খাদ্যশষ্য উৎপাদন হয়, তাতে গুদাম উপচে পড়ে। রাখার জায়গা নেই। খোলা জায়গায় খাদ্যশষ্য রাখার ফলে তা পচছে, পোকায় কাটছে। তার উপর সরকারের একগুচ্ছ পরিকল্পনা রয়েছে। খাদ্য সুরক্ষা আইন আছে। তার মানে মানুষের খাদ্যের অধিকার আছে। গ্রামের দিকে বছরে একশ দিনের কাজের অধিকার আছে। তারপরেও কী করে এই অবস্থা হতে পারে? ফুড পলিসি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের গ্রামে থাকা ৭৬ শতাংশ মানুষই পুষ্টিকর খাবার পান না।
কলকাতা ও দিল্লিতে দীর্ঘদিন ধরে বিজনেস রিপোর্টিং করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক অঞ্জন রায়। তিনি বণিকসভা ফিকির পরামর্শদাতাও ছিলেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''আমাদের যা খাদ্যশষ্য মজুত আছে, তাতে এরকম হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমাদের গলদ আছে খাবার পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে। সেখানে দুর্নীতি এত বেশি যে বলার নয়।''
অঞ্জনের মতে, ''আমাদের দেশে খাদ্যশষ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার খুবই কম। কিন্তু ডাল, দুধ, সবজি, ফলের দাম অনেকটাই বেড়েছে। ফলে সেটা সাধারণ মানুষের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। গরিব লোকের পুষ্টির অনেকটাই আসে ডাল থেকে। সেটা হাতের বাইরে চলে গেলে অপুষ্টি বাড়বেই।''
অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ বলেছেন, ''২০১৩ সালে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন পাস হওয়ার পর থেকে ভারতে অপুষ্টি সমস্যার মোকাবিলায় কোনো বড় পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।'' 'খাদ্যের অধিকার'আন্দোলনের নেত্রী কবিতা শ্রীবাস্তব মনে করছেন, ''বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই ভারতকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। মাথাপিছু গড় আয়, অপুষ্টির হার কমিয়ে আনা, জিডিপি'র হার বৃদ্ধি সবেতেই তারা উন্নতি করছে। নারী শিক্ষায় বাংলাদেশ আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। স্কুল শিক্ষায় কর্মসংস্থানেও বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে।''
এ এক অদ্ভূত বাস্তবতা ভারতের। খাবার উপচে পড়ে। অথচ মানুষ খাবার পান না। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গাদা গাদা প্রকল্প আছে। সেই প্রকল্পের সঠিক রূপায়ণ হলে গরিবের ক্ষুধা থাকারই কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তব অবস্থা আলাদা হয়ে যায়। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, পরিকাঠামোয় গলদ, অজ্ঞানতা এবং প্রকল্প রূপায়ণে ত্রুটির ফলে ক্ষুধার ক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে পড়ছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত।
২০১৯ সালের ছবিঘরটি দেখুন...