ঘুস লেনদেনের দায়ে ডিআইজি মিজান ও দুদকের বাছিরের কারাদণ্ড
২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানায়, বুধবার আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৪ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শেখ নাজমুল আলম৷
পুলিশের বরখাস্ত উপ-মহাপরিদর্শক মিজানুর রহমানকে দণ্ডবিধির ১৬৫ এ ধারায় ৩ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছিরকে দণ্ডবিধির ১৬১ ধারায় ৩ বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি মুদ্রা পাচার আইনে ৫ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, ৮০ লাখ জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সাজা দেওয়া হয়েছে৷ তবে দুই ধারার সাজা একসঙ্গে খাটতে হবে বলে বাছিরকে সব মিলিয়ে ৫ বছর জেল খাটতে হবে৷ দুজনের ক্ষেত্রেই হাজতবাসের সময় বাদ যাবে৷
এর আগে মিজানকে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এবং বাছিরকে নারায়ণগঞ্জ থেকে আদালতে হাজির করে বেলা ১১টার পর তাদের তোলা হয় কাঠগড়ায়৷
মামলার বৃত্তান্ত
এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় মিজানকে৷ এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক; এক হাত ঘুরে সেই অনুসন্ধানের দায়িত্ব পান কমিশনের তৎকালীন পরিচালক এনামুল বাছির৷ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই ডিআইজি মিজান দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন দুদক কর্মকর্তা বাছির৷
এর পক্ষে তাদের কথপোকথনের কয়েকটি অডিও ক্লিপ একটি টেলিভিশনকে দেন তিনি৷ ওই অডিও প্রচার হওয়ার পর দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা৷ অভিযোগটি অস্বীকার করে বাছির দাবি তখন করেন, তার কণ্ঠ নকল করে ডিআইজি মিজান কিছু ‘বানোয়াট’ রেকর্ড টেলিভিশনকে সরবরাহ করেছেন৷ ডিআইজি মিজান বলেন, সব জেনেশুনেই তিনি কাজটি করেছেন ‘বাধ্য হয়ে’৷
২০১৯ সালের ১৬ জুলাই দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ সংস্থার পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেন এবং পরে অভিযোগপত্র দেন৷
‘অবৈধভাবে সুযোগ প্রদানের হীন উদ্দেশ্যে’ এনামুল বাছির ডিআইজি মিজানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুস গ্রহণ করেছেন বলে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয় অভিযোপত্রে৷ ঘুসের অভিযোগ ওঠার পর তাদের দুজনকেই সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল৷ ২০২০ বছরের ২২ জুলাই দুদকের একটি দল এনামুল বাছিরকে গ্রেপ্তার করে৷ আরেক মামলায় গ্রেপ্তার ডিআইজি মিজানকেও পরে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়৷
গত বছর ১৮ মার্চ আসামিদের অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশের পর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ৷ গত ২৩ ডিসেম্বর মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে মামলায় চার্জশিটভুক্ত ১৭ সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্য শোনেন আদালত৷
এই সাক্ষীরা হলেন, মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা দুদক পরিচালক. শেখ মো. ফানাফিল্যা, দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ, দুদকের প্রশিক্ষণ শাখার প্রধান সহকারী এস এম আবু জাফর বিশ্বাস, দুদক প্রধান কাযালয়ের প্রশিক্ষণ শাখার কনস্টেবল মো. অলিউজ্জামান শেখ, দুদকের বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখার উচ্চমান সহকারী মো. জিল্লুর রহমান, দুদকের মানব সম্পদ বিভাগের সহকারী পরিচালক আজিজুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম নাজেম আহমেদ, মেজর নাহিদ আল আমিন, কমান্ডার এম মোতাহার হোসেন, মেজর ফাহিহম আদনান সিদ্দিকী, বরগুনার বেতাগি থানার কদমতলা গ্রামের মো. নাছির উদ্দিন বাবু, বরিশাল, ডিআইজি মিজানের অর্ডারলি কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেন, মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার রুহুল্লি গামের বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত গাড়িচালক এস এম এনামুল হক, বরিশালের মূলাদির কাজিরচরের হৃদয় হাসানি এবং মিজানের স্ত্রীর দোকানের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম৷
যুক্তিতর্ক শুনানির আগে ৩ জানুয়ারি আত্মপক্ষ শুনানিতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন মিজানুর রহমান ও এনামুল বাছির৷ পরে ১২ জানুয়ারি মিজান ৬ পৃষ্ঠার এবং এনামুল বাছির ১২ পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য আদালতে জমা দেন৷
সাক্ষীরা যা বলেছেন
গতবছর ২৬ সেপ্টেম্বরে আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে কনস্টেবল সাদ্দাম হোসেন বলেছিলেন, ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানের উত্তরার বাসা থেকে তিনি দুটি ব্যাগ (একটি বাজারের ব্যাগ) গাড়িতে তুলে দেন৷ ব্যাগে ২৫ লাখ টাকা এবং কিছু বই ছিল৷
ডিআইজি মিজান পরে সাদ্দাম হোসেনকে রাজারবাগে নামিয়ে দেওয়ার কথা বলে গাড়িতে তোলেন৷ কিন্তু সাদ্দামকে তিনি রমনা পার্কের সামনে নিয়ে যান এবং বলেন তার সাথে কথা বলার জন্য একজন লোক আসবে৷
সাদ্দাম আদালতকে বলেছেন, কিছুক্ষণ পরে এক লোক রমনা পার্কে আসেন এবং মিজানের সঙ্গে পার্কের ভেতরে গিয়ে কথা বলেন৷ পরে তারা গাড়িতে ওঠেন৷ ডিআইজি মিজান গাড়ির চালককে বলেন, কথা বলতে আসা সেই লোককে যেন রাজারবাগ মোড়ের সামনে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দেওয়া হয়৷
‘‘যাতায়াতের মধ্যবর্তী সময়ে তারা অনেক কথা বলেন৷ মিজান স্যার ওই লোককে বলেন, ব্যাগে ২৫ লাখ ঠিক আছে৷ তখন ওই লোক প্রশ্ন করেন যে ‘সব ঠিক আছে ভাই?’ মিজান স্যার বলেন, সব ঠিক আছে৷ পরে ওই লোকটাকে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের গলিতে নামিয়ে দেওয়া হয়৷’’
সাদ্দাম বলেছেন, লোকটি নেমে যাওয়ার পর ডিআইজি মিজানের কাছে তার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন তিনি৷ তখন ডিআইজি মিজান তাকে বলেছিলেন, লোকটি দুদক কর্মকর্তা এনামুল বাছির৷
এরপর ২৫ ফেব্রুয়ারি মিজানের বাসা থেকে একটি শপিং ব্যাগ এবং একটি হ্যান্ড বল গাড়িতে তুলে দেওয়ার কথাও আদালতে বলেছেন সাদ্দাম৷ তার দাবি অনুযায়ী সেদিন ব্যাগে ছিল ১৫ লাখ টাকা৷ সাক্ষ্যে বলা হয়, তারা সেদিনও রমনা পার্কের সামনে যান৷ এনামুল বাছির পার্কের সামনে এলে তার সঙ্গে মিজান ভেতরে যান৷ কথা শেষে তারা আবার গাড়িতে ওঠেন৷ এনামুল বাছিরকে শান্তিনগর মোড়ে নামিয়ে দিতে বলেন ডিআইজি মিজান৷ সেদিনও গাড়িতে তারা কথা বলেন৷
সাদ্দামের ভাষ্য অনুযায়ী, এনামুল বাছির সেদিন ডিআইজি মিজানকে বলেন, তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় ‘কিছু নেই'৷ তার কিছু হবে না৷ গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় এনামুল বাছির টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে যান৷
ডিআইজি মিজান ২০১৯ সালের ৩০ মে গুলশান পুলিশ প্লাজায় যান এবং এনামুল বাছির সেখানে আসেন৷ তারা সেখানেও কথা বলেন৷ সাদ্দাম সাক্ষ্যে বলেছেন, এনামুল বাছির সেদিনও ডিআইজি মিজানকে বলেন, ওই মামলায় কোনো ‘কাগজপত্র নেই’৷ তার কিছু ‘হবে না’৷
মিজানের স্ত্রীর দোকানের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে এ মামলায় সাক্ষ্য দেন৷ গুলশান পুলিশ প্লাজায় এনামুল বাছিরের সঙ্গে মিজানের এক সাক্ষাতের ঘটনা তুলে ধরে রফিকুল আদালতে বলেন, ‘‘মিজান স্যার উনাকে বলেন, টাকা দিলাম, তারপরও আমার নামে কেস হল৷’’
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
২০১৯-এর ছবিঘরটি দেখুন...