চোখের জলে বিদায়
১৯ মার্চ ২০১৮এই বিমান দুর্ঘটনায় মোট নিহত হয়েছেন ৪৯ জন৷ এর মধ্যে বাংলাদেশের ২৬ জন, নেপালের ২২ এবং একজন চীনা নাগরিক৷ বাংলাদেশি ২৬ জনের মধ্যে ২৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে৷ নেপালের ২২জন শনাক্ত হওয়ার পর সোমবারই মরদেহ তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷
বাংলাদেশি ২৩ জনের মরদেহ বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে মঙ্গলার বিকেল তিনটার পর নেপাল থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়৷ আর তাঁদের স্বজনরা ঢাকায় আসেন ইউএস-বাংলার একটি ফ্লাইটে৷ লাশ আর্মি স্টেডিয়ামে বিকেল চারটার পর নেয়া হলে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়৷ স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন৷ তাঁদের কান্না আর আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে৷ এর মাঝেও স্বজনরা একটিই দাবি করেন, ‘‘কাউকে যেন এভাবে আর দুর্ঘটনায় প্রাণ দিতে না হয়৷ যদি কোনো ত্রুটি বা অবহেলার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে, তা চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে যেন ব্যবস্থা নেয়া হয়৷’’
আর্মি স্টেডিয়ামে বাদ আসর নিহতদের জানাজা হয়৷ জানাজায় নিহতদের স্বজনরা ছাড়াও মন্ত্রীপরিষদের সদস্য এবং সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন৷ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় সংসদের স্পিকারের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়৷ এরপর বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে নিহতদের লাশ তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়৷ তাঁরা শোকে আর বেদনায় লাশ গ্রহণ করেন শেষ যাত্রার জন্য৷
জানাজায় উপস্থিত সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘মৃত্যুর তো আর ক্ষতিপূরণ হয় না৷ তারপরও আমরা তাঁদের পরিবার যাতে সঠিক ক্ষতিপূরণ পায়, সে ব্যবস্থা করবো৷ আর এই পরিবারগুলোর পাশে থাকবো আমরা৷’’
যাঁদের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে, তাঁরা হলেন, যাত্রী ফয়সাল আহমেদ, বিলকিস আরা, বেগম হুরুন নাহার, বিলকিস বানু, আখতারা বেগম, নাজিয়া আফরিন চৌধুরী, মো. রকিবুল হাসান, সানজিদা হক, মো. হাসান ইমাম, আঁখি মনি, মিনহাজ বিন নাসির, এফ এইচ প্রিয়ক, তামারা প্রিয়ন্ময়ী, মো. মতিউর রহমান, এস এম মাহমুদুর রহমান, তাহেরা তানভীন শশী রেজা, উম্মে সালমা, অনিরুদ্ধ জামান, মো. নুরুজ্জামান ও মো. রফিকুজ্জামান এবং ফ্লাইটের পাইলট আবিদ সুলতান, পৃথুলা রশীদ, ক্রু শারমীন আক্তার নাবিলা ও খাজা হুসাইন৷
আলিফউজ্জামান, পিয়াস রায় ও মো. নজরুল ইসলামের লাশ এখনও শনাক্ত হয়নি৷ তাঁদের মরদেহ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত করার পর বাংলাদেশে পাঠানো হবে৷
নিহত রফিকুজ্জামান রিমুর বন্ধু সুমন জাহিদ লাশ গ্রহণের পর ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এই দুর্ঘটনার একটি সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার৷ আমরা জানতে চাই কার ভুলে বা অদক্ষতায় এই দুর্ঘটনা ঘটল৷ ইউএস-বাংলার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো নয়৷ এর আগেও তাদের উড়োজাহাজ একাধিকবার ছোটখাট দুর্ঘটনায় পড়েছে৷ আমাদের দেশের এয়ারলাইন্স বলে তাদের পক্ষ নেয়ার কোনো বিষয় নাই৷ সঠিক কারণ জেনে ভবিষ্যতে সেই দুর্বলতাগুলো দূর করা প্রয়োজন৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘সবাই যেন সঠিক পরিমাণ ক্ষতিপূরণ পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে৷ রিমুর পরিবার ওই ক্ষতিপূরণের টাকা প্রবিবন্ধীদের জন্য ব্যয় করার ঘোষণা দিয়েছে৷ সে নিজেই প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করতো৷’’
নিহত ফয়সাল আহমেদের মামা বাহাদুর বেপারীও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে চলে গেছে, তাকে তো আর পাবো না৷ কিন্তু দুর্ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন যাকে ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রাণহানি এড়ানো যায়৷’’
ঢাকায় ইউএস বাংলার মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) কামরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সরকার, বিমান বাহিনী ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় ২৩ জনের লাশ তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷ এখন তাঁরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় লাশের দাফন করবেন৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণের জন্য ইন্সুরেন্স কোম্পানিকে আমরা চিঠি দিয়েছি৷ তারা এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে৷ নিহতদের পরিবার ও আহতরা আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পাবেন৷ আর এরইমধ্যে এই দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে৷ তদন্তে বাংলাদেশ ও নেপাল সিভিল এভিয়েশেন, আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন এবং উড়োজাহাজটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তদন্ত করছে৷ তবে তদন্ত করে দুর্ঘটনার কারণ জানতে একটু সময় লাগার কথা৷’’
নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস বলেছেন, ‘‘দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে দুই দেশের তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে, আমরা সেটাকেই সত্য ধরে নেবো৷ এ ক্ষেত্রে অনুমানের কোনো সুযোগ নাই৷’’ তদন্ত কাজে যোগ দিতে রবিবার বাংলাদেশ থেকে নেপাল গেছেন এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন গ্রুপ অব বাংলাদেশ (এএআইজি-বিডি)-র প্রধান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন এম রহমতুল্লাহ৷
গত ১২ই মার্চ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের আগ-মুহূর্তে বিধ্বস্ত হওয়ায় ২৬ বাংলাদেশিসহ ৪৯ জন নিহত হন৷ ৬৭ যাত্রী ও চার ক্রুসহ ৭১ আরোহীর মধ্যে বাংলাদেশি ছিলেন ৩৬ জন৷ নিহত বাকিদের মধ্যে নেপালের ২২ জন ছাড়া চীনের একজন যাত্রীও রয়েছেন৷ আহতদের মধ্যে ১০ জন বাংলাদেশি, ১২ জন নেপালের ও একজন মালদ্বীপের নাগরিক৷
বাংলাদেশের আহত ১০ জনের মধ্যে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯ জন দেশে ফিরেছেন৷ আর আরেক আহত যাত্রী ইমরানা কবীর হাসিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নেপাল থেকে সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে৷
লাইফ সাপোর্টে নিহত পাইলটের স্ত্রী
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনায় নিহত পাইলট আবিদ সুলতানের স্ত্রী আফসানাকে ঢাকার নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে ৷ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ড. সিরাজি শফিকুল ইসলাম জানান, রবিবার (১৮ মার্চ) রাতে স্ট্রোক করেন আফসানা৷ অপারেশন শেষে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে৷