জঙ্গিবাদ কি ইসলামসম্মত?
১০ এপ্রিল ২০১৭আইএস সংগঠনটি যার হাতে প্রথম গড়ে উঠেছিল, তার নাম আবু মুসাব আল-জারকাভি৷ নব্বইয়ের দশকে তার হাতে গড়া ‘আল তাওহিদ ওয়াল জিহাদ' নামের সংগঠনটি থেকে পরবর্তিতে আইএস বা আইসিস-এর জন্ম৷ জারকাভির জন্ম জর্ডানে৷ তরুণ বয়সে মাদক বিক্রি, যৌন নির্যাতন, ছিনতাই, মারামারি ইত্যাদি নানা অপরাধে তার বিরুদ্ধে মোট ৩৭টা মামলা ছিল৷ জিহাদি হওয়ার আগে সে ছিচকে অপরাধী ছিল, আর জিহাদি হওয়ার পরে হয় উঠলো ইন্টারনেট যুগের প্রথম সেলিব্রেটি মুজাহিদ৷ নিজেদের নৃশংস ও বর্বর কর্মকাণ্ডের ছবি বা ভিডিও প্রচার করার যে কৌশল আইএস গ্রহণ করে, তার শুরুটাও জারকাভিরই হাতে৷ ২০০৫ সালে জর্ডানের আম্মানের ভয়াবহ বোমা হামলাসহ ইরাকে সংগঠিত বহু আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়েছিল তার নির্দেশে৷ ২০০৬ সালে মার্কিন বিমান হামলায় নিহত হয় জারকাভি৷ কিন্তু তার প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এখন বাংলাদেশেও আত্মঘাতী বোমা হামলা চলছে৷
ইসলাম ও আত্মঘাতী বোমা হামলার মধ্যে সম্পর্ক যদিও মিডিয়া, বিশেষ করে পাশ্চাত্য মিডিয়ায় অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ইস্যু, কিন্তু আত্মহত্যাকে সবসময়ই মুসলিম পন্ডিতরা নিরুৎসাহিত করেছেন৷ এমন হাদিসও আছে যাতে দেখা যায় যে, আহত ও মরণাপন্ন যোদ্ধার জন্যও আত্মহত্যার অনুমতি নেই৷ হাদিসের উল্লেখ করছি এ বিষয়ে ক্লাসিকাল মুসলিম পন্ডিতদের অবস্থান বোঝানোর জন্য, আত্মঘাতী বোমা হামলা ইসলামসম্মত অথবা ইসলামসম্মত নয় – সে বিষয়ে ফতোয়া দেওয়ার জন্য নয়৷ কী ইসলাম সম্মত আর কী নয়, তা সাধারণত একটা সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতা-সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়, নির্ধারিত হয় ইসলামের নামে রাজনৈতিক বৈধতা দাবিকারী ব্যক্তি বা সংগঠনের স্বার্থ, সুবিধা ও দাবি অনুযায়ী৷ আত্মহত্যার প্রসঙ্গ বাদ দেওয়া যাক৷ ইসলামি আইনের ইতিহাসে দেখা যায় যে মুসলিম পন্ডিতরা নারী, শিশু, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সর্বোপরি নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করা যুদ্ধের সময়ও ‘জায়েজ' বলে মনে করতেন না৷ নিহতের লাশ বিকৃত না করার কঠোর বিধান ছিল৷ অথচ হোলি আর্টিজান বেকারিতে নিরস্ত্র নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে লাশের বিকৃত ছবি অনলাইনে প্রচার করাও আইএস-এর সদস্যদের কাছে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ৷ জিহাদি মা বোমা বিস্ফরণ ঘটিয়ে নিজেও নিহত হচ্ছেন, সন্তানকেও হত্যা করছেন৷ জিহাদিদের দুনিয়ায় আত্মহত্যা থেকে শুরু করে নিজের সন্তান হত্যাও ইসলামসম্মত হয়ে যাচ্ছে৷
গুলশান হামলার পর থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা শক্ত অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ জঙ্গিবাদীরা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের অনুসারী না বলে তাদের ধর্মচ্যুত করার একটা প্রবণতাও লক্ষ্য করা গেছে, যাচ্ছেও৷ কিন্তু ব্লগার, লেখক, প্রকাশকদেরকে যখন ইসলামের সমালোচনার দায়ে হত্যা করা শুরু হয়েছিল, তখন তার বিরুদ্ধে এই শক্ত সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় অবস্থানটা দেখা যায়নি৷ তা থাকলে আজকে বাংলাদেশ এই অবস্থায় পৌঁছাতো কিনা সেই প্রশ্ন তোলা যেত৷
২০১৪ সালে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা শফি একবার ঘোষণা দিলেন যে, নাস্তিকদের হত্যা করা ‘ওয়াজিব' হয়ে গেছে৷ কিন্তু ২০১৫ সালে যখন প্রায় প্রতি মাসেই একজন করে ব্লগারকে খুন করা হচ্ছিল এবং ব্লগার বিরোধী হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনটি বারবার আলোচনায় উঠে আসছিল, তখন হেফাজতে ইসলাম একবার ‘এই ধরনের হত্যাকাণ্ড ইসলামসম্মত নয়' বলে বিবৃতি প্রকাশ করে৷ সেই বিবৃতিতেই আবার এমন হুঁশিয়ারি ছিল যে, রাষ্ট্র নাস্তিকদের বিচার করে না বলেই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে৷ অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার পর যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে একটা শব্দ উচ্চারণ করেননি, সেখানে তিনি গুলশান হামলা পরবর্তি সময়ে এ ধরমের হামলা যে ইসলামসম্মত নয়, সেই বিষয়ে একাধিকবার বক্তব্য দিয়েছেন৷ দিনশেষে কোনটা ইসলামি আর কোনটা নয়, তা আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আর রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়, পরিবর্তিত হয়৷ সমাজ বা রাষ্ট্র ইসলামের নামে কী গ্রহণ করতে পারবে, কী বর্জন করতে বাধ্য হবে আর কোন বিষয়ে সম্মতিসূচক নিরবতা অবলম্বন করবে বা বিহ্বল অবস্থান গ্রহণ করবে, তাও নানান দেশীয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বিদ্যমান ক্ষমতা-সম্পর্ক দ্বারা নির্ধারিত হয়৷
কী ইসলাম সম্মত আর কী নয়, তার সাথে ক্ষমতার সম্পর্কের কারণেই বিখ্যাত নৃতাত্ত্বিক তালাল আসাদ ইসলামকে ‘ডিসকার্সিভ ট্র্যাডিশন' হিসাবে বোঝার কথা বলেন৷ ‘ট্র্যাডিশন' মানে ঐতিহ্য৷ সকল ঐতিহ্যেরই ইতিহাস থাকে৷ ইসলামি ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত সবকিছুর ইতিহাসই সাধারণত ইসলামের একেবারে প্রাথমিক যুগের সাথে যুক্ত করার প্রচলন আছে৷ কিন্তু ঐতিহ্যের কোনো কোনো অংশ ঐতিহ্য না থেকে একেবারেই ইতিহাসে পরিণত হতে পারে৷ যেমন তুরস্কে ওসমানি খেলাফতের বিলুপ্তির পরে খেলাফত বিষয়টাই ইসলামি ঐতিহ্য থেকে বাদ পরে ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছিল৷ ঐতিহাসিকভাবে ওসমানি খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের মুসলমানদের কাছে খেলাফতের বিলুপ্তি ইসলামের অস্তিত্ব সংকট হিসাবে মনে হয়নি৷ এর পেছনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি মধ্যপ্রাচ্যের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও রাজনীতি ভূমিকা রেখেছে৷ ২০১৪ সালে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস ইতিহাস থেকে বের করে এনে খেলাফতকে যে আবার ইসলামি ঐতিহ্যের অংশ বলে দাবি তুললো এবং ইরাক ও সিরিয়ার সুন্নি অধ্যুষিত অঞ্চলে তা প্রতিষ্ঠাও করতে পারলো, তা সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই৷ ইরাকে ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলা কিংবা পরবর্তিতে সিরিয়ায় ‘রেজিম' পরিবর্তনে পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া হয়ত খেলাফতের নামে আইএস-এর বর্বর রাজত্বের আবির্ভাব ঘটতো না৷ মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ‘মেইনস্ট্রিম ইসলামিস্টদের' হঠকারী, ফ্যাসিস্ট ও প্যারাডক্সিকাল রাজনীতিও মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে ভূমিকা রেখেছে৷
বাংলাদেশেও বর্তমানে যে ইসলামের নামে খুন, বোমা হামলা ইত্যাদি হচ্ছে – তার পেছনে নানান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ আছে৷ যে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা বর্তমানে বাংলাদেশে কায়েম হয়েছে এবং প্রকৃত বিরোধী দলের উপস্থিতিতে যে রাজনৈতিক ‘ভেকুয়াম' তৈরি হয়েছে, জঙ্গিবাদীদের মতো অরাজনৈতিক র্যাডিকালদের জন্যে উর্বর ভূমি তো বটেই৷ বিরোধী পক্ষ হিসাবে কট্টর ইসলামপন্থি ও জঙ্গিবাদীদের হাজির করা ‘ওয়ার অন টেরর'-এর রাজনীতি দুনিয়ার বহু ডানপন্থি ও স্বৈরশাসকদেরই পছন্দের৷
‘ওয়ার অন টেরর' নিয়ে রাজনীতি জর্জ বুশ করেছেন, আসাদও করেছেন৷ এই রাজনীতি তাঁদের কারো দেশের জন্যেই ভালো ফল বয়ে আনেনি৷ শেখ হাসিনা সরকারের ‘ওয়ার অন টেরর' কেন্দ্রিক রাজনীতিও আমাদের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ৷ এছাড়া জাতীয় রাজনীতির বাইরে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতগুলোও বিবেচনার বিষয়৷ বাংলাদেশ সম্প্রতি সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যুক্ত হয়ে জঙ্গি হামলার ঝুকি আরো বাড়িয়ে তুলেছে৷ এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই৷ তবে বলে রাখা ভালো যে তা অত্যন্ত জটিল৷
সৌদি আরব এবং ইসলামিক স্টেট – এই দুইই সালাফি আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান৷ যে আল-কায়েদা থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আইএস-এর জন্ম, সেই আল-কায়েদার জন্ম হয়েছে সৌদি আরবেরই প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায়৷ সৌদি আরবপন্থি সালাফি পন্ডিতদের সাথে আল-কায়েদাপন্থি সালাফি পন্ডিতদের প্রধান মতপার্থক্যের বিষয় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি৷ আল-কায়েদার মতে, মার্কিন সেনাবাহিনীর এই উপস্থিতি অনৈসলামিক, সৌদি আরবের মতে নয়৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে, কী ইসলামি আর কী নয়, তা দিনশেষে রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হচ্ছে৷ বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলাম মূলত আদালত প্রাঙ্গন থেকে মুর্তি অপসারণ কিংবা পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিরোধিতায় পরিণত হয়েছে৷ পাশাপাশি পরিণত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ক্ষমতাবানদের স্বার্থ রক্ষার উপায়ে, এবং অনেকক্ষেত্রে নারীর বিরুদ্ধে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা-কাঠামো টিকিয়ে রাখার মতাদর্শে৷ শান্তির পক্ষে ইসলামকে হাজির করতে দেখা যায় যখন ইসলামের নামে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা বক্তব্য দেন শুধু তখনই৷ এই হাজিরাটাও সর্বক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের সাথে করা হয় না, যেমন ইতিমধ্যে ব্লগার হত্যাকাণ্ড বিষয়টির উল্লেখ করেছি৷
সর্বোপরি আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, আমাদের সময়কার ইসলামের রাজনীতি শুধু ইসলামি নয়, প্রবলভাবেই আধুনিকও বটে৷ আধুনিক ইসলামিস্টরা ‘কালচারাল লিবারালিজম' (যেমন নারী স্বাধীনতা, ধর্ম ত্যাগের স্বাধীনতা) গ্রহণ করতে না চাইলেও, ‘ইকোনোমিক লিবারালিজম' (ইসলামি ব্যাংক) গ্রহণ করে বসে আছে এবং ইকোনোমিক লিবারালিজম যে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার মতো কালচারাল লিবারালিজম ছাড়াও দিব্বি টিকে থাকতে পারে তা ভুলে গেলে চলবে না৷ তাই শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ইন্ডাস্ট্রিয়াল উন্নয়ন, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরতন্ত্র আর জঙ্গিবাদ যে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷
জঙ্গিবাদ কি ইসলামিক না অনৈসিলামিক? যাঁরা এতক্ষণ এই লেখাটি মনযোগ দিয়ে পড়েছেন, তাঁদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে এই প্রশ্নের উত্তরও রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হওয়ার বিষয়৷ বাংলাদেশে যদি কখনও আইএস বা আল-কায়েদার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, শুধুমাত্র তাহলেই জঙ্গিবাদ ইসলামসম্মত হবে, নতুবা নয়৷
পাঠক হয়ত আমার সাথে একমত হবেন যে বাংলাদেশে কখনোই আইএস-এর মতো খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে না৷ কিন্তু বাংলাদেশ যে সিরিয়া বা ইরাকের মতো জঙ্গিবাদ কবলিত যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়ে যাবে না, সেই নিশ্চয়তা বোধহয় এখন আর দেওয়ার উপায় নেই৷ যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তা না বুঝলে জঙ্গিবাদের মোকাবেলা করা সম্ভব না৷ জঙ্গিবাদের বিরোধিতা করতে গেলে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতা কাঠামোর সমালোচক হিসাবেও আবির্ভাব করতে হবে৷ জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলতে গেলে তাই গণতন্ত্রহীনতা নিয়েও কথা বলতে হবে৷ জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলতে গেলে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়েও কথা বলতে হবে৷ গণতন্ত্রের পক্ষে বা মানবাধিকারের পক্ষে যদি সমাজ ও রাষ্ট্রের শক্ত নৈতিক অবস্থান না থাকে, তবে অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক জঙ্গিবাদকে পরাজিত করা যাবে না৷ জঙ্গিবাদ নির্মূলের ক্ষেত্রে সরকারি ‘ন্যারেটিভকে' বিনা প্রশ্নে মেনে নেোয়া যেমন ভয়ানক ভুল হবে, তেমনই বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উপস্থিতিকে সরকারি ‘কন্সপেরেসি' হিসাবে প্রচার করাও আত্মঘাতী হবে৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷