জার্মান নির্বাচনি দ্বন্দ্বযুদ্ধ ঝিমিয়ে পড়েছে
১৪ আগস্ট ২০১৭গত মাসের শেষে গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আঙ্গেলা ম্যার্কেল যেন ইচ্ছাকৃত ভাবে ২৪শে সেপ্টেম্বরের সংসদীয় নির্বাচনকে উপেক্ষা করেছেন৷ গত শনিবার তিনি ডর্টমুন্ডে – অর্থাৎ প্রতিদ্বন্দ্বী সামাজিক গণতন্ত্রীদের পেটোয়া রুর শিল্পাঞ্চলে একটি জনসভার মাধ্যমে তাঁর নির্বাচনি প্রচার অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায় শুরু করেন৷ ম্যার্কেল গোটা জার্মানিতে এ ধরনের প্রায় ৫০টি সমাবেশে আবির্ভূত হবার পরিকল্পনা করছেন – তবে ডর্টমুন্ডের সমাবেশটি ছিল তাঁর সিডিইউ দলের শ্রমিক-কর্মচারী সমিতির সামনে, কাজেই ‘নিজের মাঠে'৷ আগামীতে ম্যার্কেলকে হাটবাজারে প্রকাশ্য ব়্যালিতেও দেখা যাবে৷
ডর্টমুন্ডে আশাবাদী বক্তব্য রাখলেন ম্যার্কেল: ‘‘আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে পূর্ণ কর্মসংস্থানের লক্ষ্য অর্জন করতে চলেছি, অর্থাৎ বেকারত্বের হার তিন শতাংশের নীচে পৌঁছাতে চলেছে – এবং আমরা তা করতে পারব, বলে আমার ধারণা৷'' জুলাই মাসে জার্মানিতে বেকারত্বের হার ছিল ৫ দশমিক ৭ শতাংশ৷
অপরদিকে ম্যার্কেলকে এই প্রথম জার্মানির মোটর গাড়ি শিল্পের চলতি সংকট সম্পর্কে প্রকাশ্য মন্তব্য করতে শোনা গেল৷ জার্মানির মোটর নির্মাণ শিল্পের সুনামের যে বিপুল ক্ষতি হয়েছে, একমাত্র সেই শিল্পই তা আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে – বললেন ম্যর্কেল৷ অপরদিকে এই সংকটের জন্য তিনি গাড়ি তৈরির কোম্পানিগুলির পরিচালক মহলকে দায়ী করলেন৷ আসন্ন নির্বাচনে চ্যান্সেলর পদে তাঁর এসপিডি প্রতিদ্বন্দ্বী মার্টিন শুলৎস ইউরোপব্যাপী বিদ্যুৎ চালিত গাড়ির কোটা চালু করার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, এই অবকাশে সে প্রস্তাবটিকেও প্রত্যাখ্যান করলেন ম্যার্কেল৷
সরকারি টেলিভিশন কেন্দ্র এআরডি-র একটি জরিপ অনুযায়ী ম্যার্কেলের ভোটার সমর্থন গত সপ্তাহে হঠাৎ ৬৯ শতাংশ থেকে ৫৯ শতাংশে নেমে আসে৷ তা সত্ত্বেও ম্যার্কেলের সিডিইউ-সিএসইউ দলীয় জোট পূর্বাপর প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট পেতে চলেছে, যেখানে তাদের নিকটতম প্রতিযোগী এসপিডি দলের ২৪ শতাংশের বেশি ভোট পাবার আশা নেই৷ প্রসঙ্গত, গত নির্বাচনে এসপিডি ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷
শুলৎস এখনও আশা ছাড়েননি
ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা অথবা দলীয় ভোটার সমর্থনে ম্যার্কেলের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকলেও সামাজিক গণতন্ত্রী দলের চ্যান্সেলর পদপ্রার্থী মার্টিন শুলৎস রবিবার সরকারি জেডডিএফ টেলিভিশন কেন্দ্রের একটি সাক্ষাৎকারে বলেন যে, তিনি এখনও আঙ্গেলা ম্যার্কেলকে পরাজিত করার আস্থা রাখেন৷ এমনকি তিনি ‘চ্যান্সেলর হিসেবে' সিডিইউ দলের সঙ্গে জোট সরকারে অংশ নিতে প্রস্তুত, বলে জানান শুলৎস৷
বাস্তব এই যে, শুলৎস তাঁর নির্বাচনি প্রচার অভিযানে শিক্ষা, গবেষণা, অবকাঠামোর উন্নতি ও সামাজিক ন্যায়ের উপর জোর দিয়ে ভোটারদের আগ্রহ অথবা সমর্থন, দু'টোর কোনোটাই এ যাবৎ জাগিয়ে তুলতে পারেননি – অন্তত বিভিন্ন জরিপে তাই দেখা গেছে৷
উদ্বাস্তু সংকটের ক্ষেত্রে শুলৎস ইটালি যাত্রা করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের সারা ইউরোপে বণ্টন করার দাবি তুলেছেন৷ যুগপৎ তিনি ইউরোপে বৈধ অভিবাসনের পন্থা খোলার সপক্ষে বক্তব্য রাখেন৷ কিন্তু এক্ষেত্রেও ম্যার্কেল জার্মানিতে আরো ৪০,০০০ উদ্বাস্তু নেবার অভিপ্রায় ঘোষণা করে শুলৎসের উদ্যোগকে – অন্তত নির্বাচনি প্রচারের দৃষ্টিকোণ থেকে – ব্যর্থ করেছেন৷
উদ্বাস্তু সংকট ম্যার্কেলের জনপ্রিয়তা কমাতে পারেনি
২০১৫ সালে প্রায় নয় লাখ উদ্বাস্তু জার্মানিতে আসা সত্ত্বেও ম্যর্কেল তাঁর দলীয় সহযোগী সিএসইউ দলের তরফ থেকে উদ্বাস্তু আগমনের একটি বাৎসরিক ঊর্ধ্বসীমা নির্দিষ্ট করার দাবি মেনে নেননি৷ উদ্বাস্তু নীতির ক্ষেত্রে তিনি দক্ষিণ থেকে বাম, সব ধরনের সমালোচনার সম্মুখীন হলেও, ম্যার্কেল নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন৷
সিডিইউ দল এবার তাদের নির্বাচনি প্রচার অভিযানে ম্যার্কেলের এই স্থায়িত্ব ও স্থিতিশীলতার দিকটাকেই তুলে ধরেছে – ব্রেক্সিট থেকে ট্রাম্প, উদ্বাস্তু থেকে উত্তর কোরিয়া প্রমুখ বিভিন্ন ঝড়ঝঞ্ঝার পরিপ্রেক্ষিতে এই বার্তা দৃশ্যত জার্মান ভোটারদের কাছে মন্ত্রের মতো কাজ করেছে ও করছে৷
সামাজিক গণতন্ত্রীদের হতাশ করেছে একদিকে জার্মান ভোটারদের যে কোনো ধরণের পরিবর্তনে আপাত অনীহা; অন্যদিকে এমন এক বৈরি, যে দৃশ্যত মল্লযুদ্ধে উত্তীর্ণ হতেই রাজি নয়৷ যে কারণে শুলৎস এ মাসের গোড়ায় ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের ক্ষতি করার অভিযোগ পর্যন্ত তোলেন৷ ‘‘যে চ্যান্সেলর ভোটারদের বলেন না, তিনি কি করতে চান, তেমন একজন চ্যান্সেলর তাঁর দায়িত্বে গাফিলতি করছেন – যা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে বিপজ্জনক'', বলেন শুলৎস৷ এক কথায়, ম্যার্কেল কিছু না বললে, শুলৎস তাঁর যুক্তি খণ্ডন করবেন কি করে বা বিপক্ষ যুক্তি দেখাবেন কি করে? নিজের বিরুদ্ধে তো আর যুদ্ধ করা চলে না৷
সিডিইউ দল মওকা বুঝে একটি ‘সফ্ট ফোকাস' ক্যাম্পেইনের পথ বেছে নিয়েছে, বলছেন পর্যবেক্ষকরা৷ এবার সিডিইউ দলের নির্বাচনি স্লোগান হলো: ‘এমন একটি জার্মানি, যেখানে আমরা সুখে, ভালোভাবে থাকতে পারি'৷ সঙ্গের ছবিটিতে এক তরুণী তৃণভূমির মাঝখানে শুয়ে রয়েছেন – নিদ্রিত অবস্থায়৷
ভোটররা যখন স্ট্যাটাস কুও নিয়ে খুশি, তখন পরিবর্তন আনা – বিশেষ করে সরকারে পরিবর্তন আনা – প্রায় অসম্ভব৷ জার্মান ভোটাররা আপাতত দেশের অর্থনৈতিক সুস্বাস্থ্য, উদ্বাস্তু নীতি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা অবধি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন বৃহৎ জোটের সমঝোতা, ও সেই সঙ্গে এএফডি-র মতো নতুন পপুলিস্ট দলগুলিকে উপেক্ষা করার সফল কৌশলে এতই সন্তুষ্ট যে, তারা ম্যার্কেল গরমের ছুটিতে প্রতিবছরের মতো পাহাড়ে হাইকিং করতে গেলেও জরিপে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ে বৈ কমে না৷
এসি/ডিজি (ডিপিএ, এএফপি)