তরুণ অভিবাসী
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১২আত্মপরিচয়ের খোঁজে
তরুণ অভিবাসীরা প্রায়ই প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আমি ঠিক কোন দেশের মানুষ? যে দেশ থেকে আমার বাবা-মা এসেছেন, নাকি যে দেশে আমি বসবাস করছি?'' অনেকে নিজের কাহিনি নিয়ে বই লিখেছেন৷ তাতে যে সব সময় স্পষ্ট পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়, তা নয়৷ অভিবাসী হিসেবে সফল হওয়ার একটা বাড়তি চাপ বাবা-মা'রাই দিয়ে থাকেন৷ অন্যদিকে সমাজে বহিরাগতদের সম্পর্কে যে সব বদ্ধমূল ধারণা চালু আছে, সে সবেরও সম্মুখীন হতে হয় অনেককে৷ তা সত্ত্বেও যারা সমাজে নিজেদের জায়গায় করে নিয়েছেন, তাদের সাফল্য চোখের পড়ার মতো৷
ইরানের তিন তরুণের সাফল্যের কাহিনি
মোজতাবা, মাসুদ ও মিলাদের কথাই ধরা যাক৷ ১৯৯৬ সালে মায়ের সঙ্গে ইরান থেকে পালিয়ে জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছিল তিন ভাই৷ সরকারের সমালোচনা করে পরিবারটি দেশে টিকতে পারে নি৷ নতুন দেশে এসে নানা রকম বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তারা সেরা নম্বর পেয়ে ‘আবিটুয়র' বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করেছে৷ শুধু তাই নয়, তিনজনেই বৃত্তি নিয়ে ‘এলিট' বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে৷ বিপুল উৎসাহে এমন উজ্জ্বল সাফল্য তুলে ধরেছিল সংবাদ মাধ্যম৷ রাজনীতিক নেতারাও তাদের আদর্শ অভিবাসী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টায় কার্পণ্য করেন নি৷
‘মনে ঠিকমতো ইচ্ছা থাকলেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়' – এই বিশ্বাসটুকু সম্বল করে এই তিন ইরানি তরুণ সমাজে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে৷ ‘অনভিপ্রেত – জার্মানিতে ইরানের তিন ভাইয়ের অভিজ্ঞতা' – এই শিরোনামে তারা একটি বই লিখেছে৷ ২৮ বছর বয়স্ক মোজতাবা সাদিনাম বলে, সমাজের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত হওয়ার পথে তাদের সামনে অসংখ্য বাধা সৃষ্টি করা হয়েছিল৷ তার যমজ ভাই মাসুদেরও একই প্রশ্ন, ‘‘আচ্ছা বলুন তো, শহরের বাইরে বিশেষ ক্যাম্পে বন্ধ করে রাখলে আমরা কীভাবে সমাজে সম্পৃক্ত হতে পারি? কাজ করে উপার্জন করতে না দিলে কীভাবেই বা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে পারি?''
প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই
বছরের পর বছর ধরে সাদিনাম পরিবার কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনার শিকার হয়েছে৷ কেউই কোনো কিছুর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ছিল না৷ যেন দায় এড়ানোই গোটা ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য৷ এক সময়ে তাদের ইরানে ফেরত পাঠানোর হুমকিও শোনা গিয়েছিল৷ তখন তাদের মা উদভ্রান্ত হয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন৷ সে সময়ে জার্মানির অভিবাসন আইনে পরিবর্তনের ফলে শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে থাকার অধিকার অর্জন করে তারা৷ তার পরের কাহিনি সাফল্যে ভরা৷ মিলাদ কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে চাকরি করছে৷ তার দুই ভাই ফ্রাঙ্কফুর্টে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে৷ ২০১২ সালের শুরুতে গোটা পরিবার জার্মান নাগরিকত্ব পেয়েছে৷
বোয়াতেং পরিবারের কাহিনি
জার্মানিতে প্রায় ১ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ বিদেশি অথবা বিদেশি বংশোদ্ভূত৷ অর্থাৎ হয় তারা নিজেরা, অথবা তাদের বাবা-মা'য়েদের মধ্যে কমপক্ষে একজন বিদেশ থেকে জার্মানিতে এসেছে৷ আরও তিন ভাইয়ের কথা ধরা যাক৷ জর্জ, কেভিন ও জেরোম বোয়াতেং'এর শিকড় আফ্রিকার দেশ ঘানায়৷ এক বাবা ও দুই মায়ের সন্তান তারা৷ থাকে বার্লিনের এমন এক পাড়ায়, যেখানে সমস্যার অভাব নেই৷ তিনজনই ফুটবল-পাগল৷ নানা জাতের কুকুর ‘ব্রিডিং' করে জর্জ বেশ নাম করেছে৷
ইটালির এসি মিলান ক্লাবে ফুটবল খেলছে কেভিন, ঘানার জাতীয় দলেও নিজের স্থান করে নিয়েছে এই তারকা৷ আর জেরোম'কে কে না চেনে! খোদ বায়ার্ন মিউনিখ ক্লাবের জার্সি চড়িয়ে এবং জার্মান জাতীয় দলে খেলে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেছে এই তরুণ৷ এই তিন ভাইয়ের কাহিনিও সহজ নয়৷ সমাজে নিজেদের স্থান করে নিতে তাদেরও যে সব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তার তালিকা দীর্ঘ৷ কখনো যোগ্য জার্মান নাগরিক, কখনও বা খারাপ বিদেশি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে তাদের৷
তিন তরুণীর সাফল্য
দৃষ্টান্তের অভাব নেই৷ তুরস্কের ও্যজলেম টপচু, পোল্যান্ডের অ্যালিস বোটা ও ভিয়েতনামের খুয়ে ফাম – তিনজনই অভিবাসী পরিবারের কন্যা৷ জার্মানির সম্ভ্রান্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ডি সাইট'এ সম্পাদক হিসেবে কাজ করে এই তিন তরুণী৷ তারাও একসঙ্গে একটি বই লিখেছে৷ নাম ‘আমরা নব্য জার্মানরা – আমরা কারা, কী চাই'৷
তারা বলে, আসলে কিন্তু জার্মানিতে তারা অত্যন্ত ভালোভালে বসবাস করছে৷ তারা শুধু জানে না, দেশটিকে কী বলে ডাকবে – নিজের দেশ? নিজের বাড়ি? না কি বিদেশ? ও্যজলেম টপচু, অ্যালিস বোটা ও খুয়ে ফাম'এর আকাঙ্ক্ষা একটাই৷ তারা এমন এক জার্মান সমাজের স্বপ্ন দেখে, যেখানে ‘বিদেশি বংশোদ্ভূত' তকমাটাই থাকবে না৷ সেখানে জার্মানই হবে একমাত্র পরিচয়৷ অ্যালিস বলেন, ‘দেখতে শুনতে অন্যরকম হলেও আমরা তো সমষ্টিরই অংশ মাত্র৷''
৯ বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে জার্মানিতে এসেছিল অ্যালিস৷ খুয়ে ফাম ১৯৮২ সালে বার্লিনে এক ভিয়েতনামি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে৷ জার্মান তার মাতৃভাষার মতো৷ তা সত্ত্বেও সকলে প্রশ্ন করে, তার ‘আসল' দেশ কোথায়৷ অথচ সে চায়, উৎস নয়, শুধু তার দক্ষতা বা ক্ষমতার মূল্যায়ন করা হোক৷ যে সরকারি কর্মচারী ও্যজলেম'এর হাতে জার্মান নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট তুলে দিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তিনিই মাসের পর মাস ধরে তার দিকে তাকিয়েই দেখতে চান নি৷
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
এই প্রজন্মের নানা পরিচয়৷ তারা এমন এক দেশে থাকে, যেখানে তারা বড় হয়ে উঠেছে৷ তবে তাদের শিকড় শুধু সেই দেশেই সীমাবদ্ধ নয়৷ তারা সমাজের অংশ হতে চায়, কিন্তু সব সময় পারে না৷ তাদের বইয়ে যে সব প্রশ্ন উঠে আসে, তা বৃহত্তর জার্মান সমাজের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ৷ এর মধ্যে একটি হলো, ‘‘ভবিষ্যতে আমরা এই দেশে কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে বসবাস করবো?''
প্রতিবেদন: সুজানে ফন শেঙ্ক/এসবি
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ