জার্মানিতে বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের রয়েছে নানা অসুবিধা
১৫ আগস্ট ২০১১জার্মানিতে পড়াশোনা হচ্ছে পড়া, শেখা এবং জানা একসঙ্গে৷ ক্লাসে যা পড়ানো হচ্ছে তা শিখতেই হবে এবং তা জেনে রাখা ভাল৷ বিষয় সাপেক্ষে তার পরিবর্তন হতে পারে৷ প্রতি সেমেস্টারে শিক্ষক ক্লাসে ঢুকবেন কয়েকশ স্ক্রিপ্ট হাতে নিয়ে৷ তা বিতরণ করবেন ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে৷ সেখান থেকেই পড়াবেন৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই স্ক্রিপ্টই যথেষ্ট৷ এর পাশাপাশি অন্তত তিন-চারটি বই ঝালাই করতে হবে – এবং তা করতে হবে নিজেকে, একেবারে একা৷
এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে যখন তাদের টিউটোরিয়াল বা হোমওয়ার্ক করতে বলা হয়৷ কারণ তা করতে হবে একা, কারো সাহায্য না নিয়ে৷ এবং এটা বেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জ৷ কারণ, দেশে আমরা সবসময়ই গ্রুপ স্টাডিজের সাহায্য নিয়ে থাকি৷ কিন্তু জার্মানিতে প্রতিদিনই ইউনিভার্সিটির ক্লাসের পর বাড়িতে নিজেকে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করতে হয়৷
তানিয়া কুপিশ হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইটালিয়ান ভাষা শেখান৷ মৌখিক পরীক্ষা হচ্ছে৷ ক্লাস রুমের বাইরে ‘পরীক্ষা চলছে, নীরবতা পালন করুন '– লিখে দরজায় লাগিয়ে রাখা হয়েছে৷ তানিয়া কুপিশ তিন বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ কিন্তু ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা ভাল হচ্ছে না৷ কেউই ভাল নম্বর পাচ্ছে না৷ তানিয়া জানান, ‘‘ছাত্র-ছাত্রীদের একাই শেখার কাজটা করতে হবে৷ আমরা শুধু বুঝিয়ে দিতে পারি, বই ছাড়া বিভিন্ন কাগজ পত্র দিতে পারি৷ কিন্তু এরপর বাড়ির কাজ, শেখার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হয়৷''
তাই ৩৭ বছর বয়স্কা শিক্ষিকা সবসময়ই চেষ্টা করেন বিভিন্নভাবে ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য করতে৷ ছাত্র-ছাত্রীরা চাইলে দিনের যে কোনো সময়ে তারা তানিয়ার কাছে আসতে পারে৷ এছাড়া ই-মেলের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর তিনি ক্রামাগত দিয়ে যান৷ তানিয়া বলেন, ‘‘এমন দিনও গেছে যে, আমি প্রায় একশো ই-মেলের জবাব দিয়েছি৷ এখন সব ই-মেলের উত্তর দেয়া সম্ভব হয় না৷ এতো সময় আমার হাতে নেই৷''
শিক্ষকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ প্রয়োজন
ডামারেস সিমারমান অর্থনীতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে কখনোই শিক্ষকদের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ করেনি৷ ব্রাজিলের এই ছাত্রীর নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে বেশ সমস্যা হয়েছিল৷ তার কথায়, ‘‘ব্রাজিলে আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি৷ সেখানে অধ্যাপকরা আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন৷ ক্লাসের পর ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের প্রতিটি বিষয় বেশ ভালভাবে বুঝিয়ে দিতেন৷ অধ্যাপকরা আমাদের বলে দিতেন কোন বইটি ভাল, বইটি কোথায় পাওয়া যাবে৷ সেই বিশ্ববিদ্যালয় এতো বড়ও ছিল না৷ সব কিছুই ছিল অন্যরকম৷''
স্বাভাবিকভাবেই, বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্যের প্রয়োজন অনেক বেশি৷ অভিজ্ঞতার আলোকে কথাগুলো জানান অর্থনীতির অধ্যাপক থোমাস এগার৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ইন্সটিটিউট অব ল অ্যান্ড ইকোনমিক্স'-এর পরিচালক তিনি৷ প্রায় ৩৩টি বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে পড়াশোনা করছে৷ আর সবাই এসেছে তার নিজের দেশ থেকে বিভিন্ন ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে৷ তিনি জানান, ‘‘আমার কাছে সবচেয়ে বেশি অবাক করে বেশ কিছু দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের আচার-আচরণ৷ যেমন ভারত বা ইসরায়েল থেকে যারা আসে, তারা ক্লাসে প্রচুর প্রশ্ন করে, সহজে কোনো কিছু মেনে নিতে চায় না, অসংখ্য যুক্তি-তর্ক দেখায়৷ সেই তুলনায় চীনের ছাত্র-ছাত্রীরা খুবই পরিশ্রমী৷ তারা ক্লাসে বিশেষ কোন প্রশ্ন করে না৷ এদের সবার শেখা, লেখা এবং উপস্থাপনের পার্থক্য দেখা যায় পরীক্ষার খাতায়৷ একেকজনের লেখা এবং চিন্তাধারা একেকরকম৷''
ভাষা শুধু সমস্যা নয় বিশাল একটি বাধা
ভাষা একটি বড় সমস্যা – এটি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই৷ লেকচার অনুষ্ঠিত হয় জার্মান ভাষায়৷ পরীক্ষাও দিতে হয় জার্মান ভাষায়৷ সেই ভাষাগত সমস্যার কথা জানাল ব্রাজিলের ছাত্রী সিমারমান৷ বললো, ‘‘শুরুতে আমি সারাক্ষণ বাসায় বই নিয়ে পড়ে থাকতাম৷ ক্লাসে কী পড়ানো হয়েছে, অধ্যাপক কী বলেছেন - সেগুলো তুলে নিয়ে আসতাম৷ সবকিছু আমি প্রথমে পর্তুগিজ ভাষায় অনুবাদ করতাম, ইন্টারনেটেও পর্তুগিজ ভাষায় রিসার্চ করতাম, সবকিছুই শিখেছি পর্তুগিজ ভাষায়৷ কিন্তু অনেক পরে এসে বুঝেছি - না, পরীক্ষায় পাস করতে হলে সবকিছু জার্মান ভাষাতেই পড়তে হবে, শিখতে হবে৷''
তবে এসব সমস্যায় পড়তে হয় প্রতিটি বিদেশি ছাত্র-ছাত্রীকে৷ অর্ধেকেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী এসব সমস্যার সামনে টিকতে না পেরে পড়াশোনা ছেড়ে দেয়৷ এমনকি পড়াশোনা শেষ না করে নিজ দেশে ফিরে গেছে - এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও অনেক৷ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছ থেকে কিন্তু এহেন তথ্যই পাওয়া গেছে৷
প্রতিবেদন: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ