ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা ভাবলেই আসে পুরান ঢাকার নিমতলী কিংবা সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসের নাম৷ একযুগ আগে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামের আগুন লাগে৷ তিন ঘণ্টার আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন৷
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানায় ১১১ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যান৷ আহত হন কয়েক শ মানুষ৷ ৯তলা ভবনটির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে লেগেছিল ১১ ঘণ্টা সময়৷
ওই দুই অগ্নিকাণ্ডের একযুগ বা এক দশক পর এসেও কেন আগুন নেভাতে এত দীর্ঘ সময় চলে গেল-ঘুরে ফিরে এসেছে সেই প্রশ্ন৷ উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেছে তথ্যের ঘাটতি৷
শনিবার রাতে যখন ডিপো পুড়ছিল, ফায়ার সার্ভিস যখন আগুন নেভানোর প্রাণান্ত চেষ্টা করছিল, তখন ডিপো কর্তৃপক্ষ ছিল নিশ্চুপ৷ সেখানে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বা কোনো ধরনের রাসায়নিক যে ছিল, সে তথ্য ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি তারা৷
আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় ব্যয়ের পেছনে যে কারণগুলো এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা গেছে, তার মধ্যে আছে: পুরো ডিপো জুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের জার, রাসায়নিকের সব কন্টেইনার শনাক্ত করতে না পারা, কন্টেইনার কেটে আগুন নেভানো এবং ডিপোর যন্ত্রপাতির সংকট৷
আয়তনে ২৪ একরের ডিপোটির পুরোটা জুড়ে ছিল কন্টেইনার৷ আগুনও ছড়িয়ে পড়ে সবখানে৷ কিন্তু পাওয়া যায়নি পর্যাপ্ত পানি৷ ফলে ভুগতে হয়েছে ফায়ার ফাইটারদের৷ আশপাশের অন্তত ছয়টি পুকুরের পানি ফুরিয়ে যাওয়ার খবর এসেছে৷
শনিবার রাতের দাউ দাউ আগুন ও বিকট শব্দের বিস্ফোরণ পর দিনভরও থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়েছে৷ ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেতে হয়েছে নির্বাপণকারীদের৷ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৪৬ জন৷ যাদের মধ্যে ফায়ার ফাইটার ছিলেন ৯ জন৷
রাসায়নিকের বিষয়ে না জেনে পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এত বেশি কর্মী হতাহত হয়েছে বলে দাবি করছেন ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. আনিসুর রহমান৷ রাসায়নিক থাকলে আগুন নেভাতে প্রয়োজন হয় ফগ সিস্টেমের৷ ফলে তথ্য ঘাটতি থাকলে পরিস্থিতি যে জটিলতর হতে পারে তার আরও একটি উদাহরণ দেখল গোটা দেশ৷
আগুনের ভয়াবহতা আর বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ডিপোর কনটেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে দায়ী করেছে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস৷ এই রাসায়নিক অ্যাভিয়েশন শিল্পে ব্যবহার করা হয়৷ যা উচ্চ চাপে এই বোতলজাত করা হয়৷ রপ্তানির জন্য কনটেইনারে করে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিএম ডিপোতে রাখা ছিল৷
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অফিস জানিয়েছে, প্রাণঘাতি দুর্ঘটনার পরই তারা জানতে পেরেছে সেখানে রাসায়নিক রাখা ছিল৷ বিএম কন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার কোনো অনুমতি নেই বলেও গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন৷
যদিও ডিপো কর্তৃপক্ষের দাবি, তাদের সব ধরনের অনুমোদন রয়েছে৷ আবার দুর্ঘটনাস্থল ঘুরে এসে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী অবশ্য ডিপোর কর্তৃপক্ষের পক্ষেই সাফাই গাইলেন৷ মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, ‘এটা কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য নয়৷ এখানে অন্য একটি এ ধরনের ইয়ে দিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, এমন একটি ইয়ে...৷ যেহেতু এটা বিস্ফোরক নয়, তাই তাদের এটা ডিক্লেয়ার করার কিছু নেই৷ ব্যাপারটা এ রকমই৷ আমরা যাওয়ার আগে এক ধরনের চিন্তা করেছিলাম, যাওয়ার পরে আমরা আরেক ধরনের ব্যবস্থা দেখলাম৷’
এখানেই শেষ নয়৷ বিতর্ক তৈরি হয়েছে মৃতের সংখ্যা নিয়েও৷ সোমবার সকালেও মৃতের সংখ্যা জানা যাচ্ছিল ৪৬৷ দুপুর গড়াতেই সেই সংখ্যায় আনা হলো সংশোধন৷ জানানো হলো সংখ্যাটি হবে ৪১৷
মৃতের সংখ্যা নিয়ে জটিলতার ব্যাখ্যায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেছিলেন, ‘একাধিক হাসপাতালে মরদেহ থাকায় গণনায় ভুল হয়েছে৷ একই মরদেহ দুবার কাউন্ট হয়েছে৷ পরে সবগুলো মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে আসার পর প্রকৃত সংখ্যা ৪১ জন পাওয়া গেছে৷'
বুধবার দিন পর্যন্ত এসে সেই সংখ্যা ৪৬-এ দাঁড়িয়েছে৷ সংখ্যাটি আরও বাড়তেও পারে৷ কারণ উদ্ধার অভিযান এখনও শেষ হয়নি৷
বাংলাদেশে যত দুর্ঘটনাই ঘটে মৃতের সংখ্যা নিয়ে প্রতিবারই কোনো না কোনো গড়মিল হয়৷ কেন হয় তার সদুত্তর পাওয়া যায় না৷ ফলে জনমনে তৈরি হয় বিভ্রান্তি৷ অজানা আশঙ্কায় ভোগেন স্বজনেরা৷ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বরাবরই হতাশ করেছেন এসব ক্ষেত্রে৷
বিএম ডিপোতে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় নতুন অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের চিকিৎসকেরা৷ তারা জানিয়েছেন, ভর্তি ২০ অগ্নিদগ্ধ রোগীর ১৯ জনের চোখে দেখা দিয়েছে নানা জটিলতা৷ এর আগে দগ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চোখে এমন উপসর্গ পাওয়া যায়নি৷
কারণ ব্যাখ্যা করে দায়িত্বরত চিকিৎসক এস এম আইয়ুব হোসেন জানিয়েছেন, ‘মানুষের চোখের পাতা স্বাভাবিকভাবে কিছু পড়ার আগে বন্ধ হয়ে যায়৷ তবে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণ ঘটনায় দগ্ধদের চোখের পাতা বন্ধ হওয়ার আগেই অনেক গরম বাতাস ও ক্ষুদ্র কণা প্রচণ্ড গতিতে আঘাত হেনেছে৷ যে কারণে কারও কর্নিয়ায়, কারও চোখের পাতায় ক্ষত দেখা দিয়েছে৷'
তবে আশার কথা হচ্ছে চোখে নানা জটিলতা দেখা দিলে দৃষ্টিহীন হওয়ার মতো শঙ্কায় কেউ নেই৷
রাসায়নিকের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা ছাড়াই উদ্ধারকর্মীরা যখন প্রাণপণ লড়াই করছিলেন ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণ করার, প্রাণহানি ঠেকানোর তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে গুজব৷
‘বিশেষ ঘোষণা: পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান স্থগিতের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর…’ শিরোনামে একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ল ফেসবুকে৷ যা ভাইরাল হতে সময় লাগল না৷ সেই পোস্টে বলা হলো, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী আয়োজনের টাকার সঙ্গে ফান্ড থেকে আরও টাকা যোগ করে ফায়ার সার্ভিসের জন্য আরও চারটি ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার কেনার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷
অথচ এই পোস্টের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি৷ নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গণমাধ্যমকর্মীদের এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন৷ এই উদ্বোধনের সঙ্গে এই ঘটনাটা জড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ উদ্বোধনের যে আয়োজন এতে যে অর্থটা খরচ হবে সেটা ন্যূনতম৷
‘এই অর্থ দিয়ে আগুন মোকাবিলায় হেলিকপ্টার কেনা হবে- গুজব ছড়ানো হয়েছে৷ মিলিয়ন ডলার এখানে ব্যয়, সেটার সঙ্গে এটা খুবই যৎসামান্য৷ এটা পপুলার একটি গুজব৷ এই যে মিলিয়ে দেয়া হলো, পাশাপাশি নাশকতার ধারণা করা হচ্ছে৷ এটাতে খুবই যোগসূত্র পাওয়া যায়৷’
এটির রেশ না কাটতেই আবার সামনে আসে নতুন আরেকটি গুজব৷ গুজবের হাত ধরে ফেরি হলো এসিড বৃষ্টির খবর৷
ফেসবুকে দেয়া পোস্টে বলা হয় (বাক্য ও বানান অপরিবর্তিত), ‘ব্রেকিং... সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে৷৷ আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে কোন বৃষ্টি আসলে কেউ এটা তে ভিজবেন না৷ চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড ভয়াবহ আগুনে যে, রাসায়নিক কেমিক্যাল গুলো ঝলসে গেছে৷ তার ফলে আকাশের মেঘ গুলোতে HYDROGEN PER OXIDE GAS টা মিশে গিয়েছে৷ সকলকে সতর্ক বার্তাটি প্রদান করুন, নিজে বাঁচুন, অন্য কে ও সাহায্য করুন৷ বিশেষ করে বৃদ্ধদের বৃষ্টির সময় ঘর থেকে বের হতে দিবেন না৷ -ডিএমপি পরিচালক’
অথচ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপিতে ‘পরিচালক’ হিসেবে কোনো পদ নেই৷ কারা এমন তথ্য প্রচার করছে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে বলেও জানানো হয় ডিএমপি থেকে৷
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মেঘে মিশে যাওয়ার দাবির বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই বলে দাবি করছেন রসায়নবিদরা৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম গোলজার হোসাইন বলছেন ভিন্ন কথা৷ তিনি জানান, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড মূলত ডিকম্পোজ হয়ে অক্সিজেন তৈরি হয়৷ এই এইচটুওটু (H2O2) মূলত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন৷ এটাকে ভেঙে অক্সিজেন রিলিজ হয় আর পানি তৈরি হয়৷ হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডকে যদি কনটেইনারে রাখা হলে উত্তাপে অক্সিজেন রিলিজ হয়ে ব্লাস্ট (বিস্ফোরিত) হয়৷’
বিএম কনটেইনার ডিপোর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মেঘের সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ আছে নিয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড সেভাবে থাকবে না৷ ওটা ডিকম্পোজ হয়ে যাবে৷ ডিকম্পোজ হয়ে গেলে অক্সিজেন বাতাসের সঙ্গে চলে যাবে, আর পানিটা নিচে থাকবে৷ এটা মেঘের সঙ্গে মেশার কোনো সুযোগ নেই৷’
এসব গুজব প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি৷ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা না গেলে গুজব ঠেকানো যাবে না৷ তাই এসব পরিস্থিতি আরও ধীর স্থির হয়ে এবং তথ্য আড়াল না করে তা প্রকাশ করলে এমন অযাচিত সংকট দেশে তৈরি হবে না৷
আগুনের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কমিটি গঠনের খবর পাওয়া গেছে৷ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপমহাপরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবারাত তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন৷
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে দ্রুত আর্থিক সহায়তা দিতে এবং নিহত ও আহত শ্রমিকদের তথ্য সংগ্রহের জন্য ১৩ সদস্যের আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে৷
৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন৷ শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে বিভাগীয় শ্রম দপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক এস এম এনামুল হক তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করেছেন৷ বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারাও দুর্ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছে৷
এর আগেও প্রায় প্রতিটি ঘটনায় করা হয়েছে তদন্ত কমিটি৷ কমিটির রিপোর্ট যেমন অনেক সময় পাওয়া যায় না, তেমনি কমিটির সুপারিশ মেনে চলারও তেমন দায় দেখা যায় না৷
ফলে নিমতলী, তাজরীন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের দোষীদের চিহ্নিত এখনও করা যায়নি৷ অনেক ক্ষেত্রে তদন্তের নেই কোনো অগ্রগতি৷ বিচার কাজে রয়েছে দীর্ঘসূত্রতা৷ ফলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে নেয়া যায়নি কোনো আইনি পদক্ষেপ৷ এসব বাস্তব চিত্র দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে তৈরি হয়েছে আস্থাহীনতা৷
জনমনে ধারণা, প্রতিটি দুর্ঘটনা তৈরি করে লাশের মিছিল৷ আর প্রাণহানির জন্য যারা দায়ি তারা থেকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ এত্তসব দেখেও মানুষ দিনশেষে আশায় বুক বাঁধে৷ অন্তত বিএম ডিপো যার স্বজন হারিয়েছেন, যারা আহত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন, তাদের আশা গঠিত তদন্ত কমিটিগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখবে৷ অপরাধীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে সরকার৷