তালেবান বিদায়ের এক দশক পর আফগানিস্তান
৭ অক্টোবর ২০১১রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়৷ তালেবান দুর্গ কান্দাহারের মানুষ এর আগে আকাশ থেকে এমন শব্দ শুনেনি৷ মার্কিন বিমান বাহিনীর বি টোয়েন্টিটু বোমারু বিমান আকাশ থেকে তালেবান ও আল কায়েদার ঘাঁটির উপর বোমা ফেলছে৷ আন্তর্জাতিক বাহিনীর অভিযান যখন শুরু হয়েছিল, সেসময়ের কথা হাবিবুর রহমানের স্পষ্ট মনে আছে৷ তখন তার বয়স ১৫৷ হাবিবুর বললেন, ‘‘তালেবানের দ্রুত পতন ঘটলো৷ আমরা জানতাম না, এর পরে কী হবে৷ মানুষের মনে ভয় ছিল, আবার আগের ওয়ারলর্ড বা গোষ্ঠীপতিরা ফিরে এসে গৃহযুদ্ধ শুরু করে দেবে৷ তবে মনে এই আশাও ছিল, যে হয়তো বা পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হবে৷''
তখন অ্যামেরিকা যে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, তার ফলে মানুষের মনে সত্যি বেশ আশা জন্মেছিল৷ আফগানিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের মনে তখন অ্যামেরিকা সম্পর্কে বিশেষ ধারণা ছিল না৷ ওয়াশিংটন সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, এই যুদ্ধ মোটেই আফগান জনগণের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে না – আল-কায়েদা ও তাদের সহযোগী তালেবানকে শায়েস্তা করতেই এই অভিযান চালানো হচ্ছে৷ তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সরকারকে হটিয়ে এক গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হবে৷ আফগানিস্তানের পুনর্গঠনের মাধ্যমে মানুষের জীবনে সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ প্রায় দুই দশক ধরে চলে আসা যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধের ফলে মানুষের তখন কাহিল অবস্থা৷ তারা এই সব প্রতিশ্রুতি শুনে আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল৷ পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি আস্থাও ছিল অটুট৷ অনেক জায়গায় মানুষের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ছিল৷ সেসময়ে কাবুল শহরের পরিবেশের কথা বলছিলেন এক শহরবাসী৷ তার কথায়, ‘‘রাতারাতি তালেবান শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল৷ পরদিন দেখা গেল তারা সবাই উধাও৷ তখন যেন বাঁধ ভেঙে গেল৷ দলে দলে মানুষ ছুটলো নাপিতের কাছে৷ তালেবানের ফরমান মেনে যে দাড়ি রাখতে হয়েছিল, তা কেটে ফেলার জন্য তারা অধৈর্য হয়ে উঠছিল৷ এমনকি পথেঘাটে দাঁড়িয়ে মানুষকে দাড়ি-গোঁফ কাটতেও দেখেছি৷ সেদিন আনন্দের জোয়ারে মানুষ ভেসে গিয়েছিল৷''
তালেবান শাসনের সময় মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কড়া নিয়ম চালু ছিল৷ পুরষদের জন্য লম্বা দাড়ি রাখা ছিল বাধ্যতামূলক৷ নারীদের কাজের অনুমতি ছিল না৷ মেয়েদের স্কুলে যাওয়া নিষেধ ছিল৷ একমাত্র বোরখা পরে বাইরে যেতে পারতো নারীরা, তাও আবার পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য সঙ্গে থাকলে৷ গান শোনা, ঘুড়ি ওড়ানো বা বল খেলা – এসব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল৷ এমনকি পছন্দমতো জামাকাপড় পরারও উপায় ছিল না৷ কাবুলের আরেক অধিবাসী বললেন, ‘‘আমার একটা চামড়ার জ্যাকেট ছিল৷ একদিন এক তালিবের পাশ দিয়ে যাচ্ছি৷ সে চেঁচামেচি করে আমার জ্যাকেট খুলে নিয়ে টুকরো-টুকরো করে কেটে ফেললো৷ সে আমাকে গালি দিয়ে বললো, এই জ্যাকেট নাকি শুয়োরের চামড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে৷ অতএব এক মুসলিমের পক্ষে এমন পোশাক পরা হারাম৷''
প্রায় দুই দশকের কঠিন পরিস্থিতির ফলে দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে মানুষের মুখে এমন অসংখ্য কাহিনী শোনা যায়৷ মার্কিন জোটের অভিযান শুরু হওয়ার পর অনেকের মনে হয়েছিল, এবার হয়তো সুদিন আসছে৷ সত্যি এক গণতান্ত্রিক সংবিধান কার্যকর হলো৷ দেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হলো৷ পশ্চিমা বিশ্ব যে নেতাকে নিযুক্ত করেছিল, সেই হামিদ কার্জাই ২০০৪ সালে বিপুল ভোটে জিতে গণতান্ত্রিক বৈধতা পেলেন৷ কিন্তু তার পরেও কাবুলের নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতির বদলে আরও অবনতি হতে লাগলো৷ তালেবান আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলো৷ গোটা দেশে শান্তির সম্ভাবনা আবার দূরে সরে যেতে লাগলো৷
প্রায় দেড় লক্ষ সৈন্য নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলি একযোগে লড়াই করেও তালেবানকে কেন হারাতে পারছে না, এই বিষয়টি আফগানিস্তানের মানুষের কাছে এখনো এক হেঁয়ালির মতো৷ তাছাড়া পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সুফলও হাতে গোনা মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে৷ তারা ধনী হয়ে উঠেছে, বাকিরা যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী আফগানিস্তানে ৭০ লক্ষেরও বেশি মানুষ এখনো দুবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না৷ দেশে যে কোটি কোটি ডলার ঢালা হচ্ছে, তার ছিটেফোঁটাও তাদের কাছে পৌঁছয় না৷ এক দশক আগে তালেবানের প্রস্থানের পর মানুষের মনে যে আশা জেগেছিল, তা এখন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷ ২০১৪ সালে বিদেশি সৈন্যদের প্রস্থানের পর তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে – অনেকের মনে এই ভয়ও রয়েছে৷ ইতিমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি আস্থাও এত কমে গেছে, যে তাদের কোনো প্রতিশ্রুতিতে আর কান দিচ্ছে না মানুষ৷
প্রতিবেদন: রতবিল শামেল / সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ