দিনে দুই দফা বাড়ছে পেঁয়াজের দাম
১৬ নভেম্বর ২০১৯ঠিক এক বছর আগে ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের মূল্য ছিল ৩৫-৪০ টাকা৷ আর আমদানিকৃতটি বিক্রি হয়েছে ২৫-৩৫ টাকায়৷ সেখানে শনিবার ঢাকায় বিদেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকা কেজিতে, দেশি ২২০-২৩০ টাকায়৷ এই পরিসংখ্যান সরকারের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ, টিসিবির৷ তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে এর চেয়েও বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে রাজধানীতে৷
পেঁয়াজের দাম বাড়ছে প্রতিদিন, যার সঙ্গে শুধু ক্রেতারাই নন, হিসাব করে উঠতে পারছেন না এমনকি খুচরা বিক্রেতারাও৷ তাই দিনের চাহিদা মিটাতে সকালে ও বিকালে অল্প পেঁয়াজ আনছেন তারা৷ তাতেও দামের পার্থক্য হওয়ায় পড়ছেন বিপাকে৷ শুক্রাবাদ বাজারের আসলাম হোসেন দেশি-বিদেশি সব ধরনের পেঁয়াজ শনিবার ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন৷ তার দোকানে তুরস্ক ও মিয়ানমার থেকে আমাদনি করা এবং দেশি সব ধরনের পেঁয়াজই আছে৷ তবে সেগুলোর দামের কোন তফাৎ নেই৷
আসলামের দাবি, তিনি এই পেঁয়াজ নিয়ে বিপাকে আছেন৷ কারণ একদিনেই পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের দাম দুই দফা করে বাড়ছে৷ তিনি জানান, ‘‘শুক্রবার সকালে কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি ২০০ টাকা কোজি দরে পেঁয়াজ কিনে আনি৷ বিক্রি করি ২২০ টাকা দরে৷ কিন্তু বিকেলে আবার সেই পেঁয়াজ আনতে হয়েছে ২৩০ টাকা কেজিতে৷ বিকেলে যখন তা ২৫০ টাকা দরে খুচরা বিক্রি করতে যাই তখন ক্রেতারা তা মানতে চান না৷ আমাদের হয়েছে বিপদ৷''
এই কারণে তার পাশের দোকানদার আব্দুল আলিম পেঁয়াজ বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘পেঁয়াজের বাজার দ্রুত আপডাউন করছে৷ তাই ভরসা পাচ্ছি না৷ মানুষের সাথে কথা রাখতে পারছি না৷ আবার আজ বেশি দামে কিনে আনব, কাল যদি কমে যায় তাহলেতো আমাদের লোকসান হবে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘পেঁয়াজ যে আনবো কতটুকু আনবো তাওতো বুঝতে পারছি না৷ কারণ মানুষ পেঁয়াজ খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে৷ আগে যারা এক কেজি কিনতেন তারা এখন ২৫০ গ্রামের বেশি কিনছেন না৷ এখন ১০-২০ টাকার বেশি পেঁয়াজ খুব কম মানুষই কিনেন৷''
ঢাকার মোহাম্মদপুর ও কাঠালবাগান বাজারে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া গেছে৷ কাঠালবাগানের আকাশ হাওলাদার মিন্টু পেঁয়াজ বিক্রি করছেন না তিনদিন ধরে৷ তার কথা, ‘‘পেঁয়াজ বিক্রি এখন ঝামেলা৷ মানুষ এখন ১০টাকার বেশি পেঁয়াজ কিনে না৷ আর বাজার অস্থির৷ দামের কোনো ঠিকঠিকানা নাই৷ প্রতিদিনই দাম বাড়ছে৷ আবার হঠাৎ করে কমে গেলেতো আরেক বিপদ৷ তাই এখন আর পেঁয়াজ বেঁচি না৷ বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমি আর পেঁয়াজ বিক্রি করব না৷ আমাদের ব্যবসা হয় সামান্যই৷ যা ব্যবসা করার পাইকারি বিক্রেতারা করেন৷ আমরা কেন ফাও ঝামেলার মধ্যে যাবো৷''
মোহাম্মদপুরের নবিউল ইসলামের পেঁয়াজের দাম নিয়ে রীতিমত ঝগড়া করতে হয়েছে ক্রেতাদের সঙ্গে৷ তিনি বলেন, ‘‘এই পেঁয়াজের কারণে আমার বাধা কাস্টমার কয়েকজন ছুটে গেছেন৷ মনোমালিন্য হয়েছে৷ তাই পেঁয়াজ বিক্রিই বন্ধ করে দিয়েছি৷''
এদিকে ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ঢাকায় খুচরা পেঁয়াজের দাম একেক দোকানে একেক রকম৷ শনিবার খুচরা ২৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হলেও কোনো দোকানে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে৷ কোথাও একই পেঁয়াজ ২১০ বা ২৩০ টাকায়ও পাওয়া গেছে৷ এর কারণ হিসেবে দোকানদার বলেন, ‘‘যে দোকানদার এক দিন আগে পেঁয়াজ কিনেছেন তিনি একটু কমে দিতে পারবেন৷ কিন্তু আজ যিনি কিনেছেন তাকে বেশি দামেই বেঁচতে হবে৷ কারণ সকাল বিকাল পেঁয়াজের দাম বাড়ছে৷''
পেঁয়াজ আসছে বিমানযোগে
বাজারে আমদানি করা পেঁয়াজের মধ্যে মিয়ানমার ও তুরস্কের পেঁয়াজের প্রাধান্যই এখন বেশি৷ সেই সঙ্গে মিশর থেকে পেঁয়াজ আসবে বলে সবাই অপেক্ষায় আছে৷ এই পেঁয়াজ আসছে বিমানযোগে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার নিজেই এক অনুষ্ঠানে ‘সুখবর' দিয়ে বলেন, ‘‘এখন পেঁয়াজ নিয়ে একটা সমস্যা চলছে৷ এই সমস্যা যাতে না থাকে সেজন্য কার্গো ভাড়া করে আমরা এখন পেঁয়াজ আনা শুরু করেছি৷ কাল-পরশুর মধ্যে বিমানে পেঁয়াজ আসা শুরু হবে৷ এখন পেঁয়াজ বিমানেও উঠে গেছে, কাজেই আর চিন্তা নাই৷'' বাণিজ্যমন্ত্রনালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই পেঁয়াজ মঙ্গলবার এসে পৌঁছাবে৷
দায়ি আমদানিকারকরা?
জানা গেছে, দেশের বাজারে বিক্রি হওয়া বিদেশি পেঁয়াজের প্রতি কেজির আমদানি মূল্য ৪২ থেকে ৬৮ টাকা৷ তারপরও খুচরা বাজারে কেন এই পাগলা ঘোড়া? এর জবাবে চট্টগ্রামের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমদানিকারকরাই এর জন্য দায়ি৷ তারা সিন্ডিকেট করছে৷ আমরা চট্টগ্রামের আমদানিকারকদের চিহ্নিত করেছি৷ সারাদেশে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন৷ কিন্তু সেটা হচ্ছে না৷ আর আমদানিকারক ও আড়তদাররা পুরো ব্যবসাটাকে পেপারলেস করে ফেলেছেন৷ তারা কোনো ডকুমেন্ট রাখছেন না৷ ফলে তাদের ধরাও কঠিন হয়ে পড়েছে৷''
এদিকে আমদানিকারক ও আড়তদাররা সবধরনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাচ্ছেন দাম বাড়িয়ে৷ তারা স্টক করার কারণে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ পচে গেছে৷ সেটিও পুষিয়ে নিচ্ছেন দাম বাড়িয়ে৷ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘আইন অনুযায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে সরকার৷''
বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি
এদিকে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বৃহস্পতিবার সারাদেশে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে আদর্শ নাগরিক আন্দোলন নামে একটি সামাজিক সংগঠন৷ তারা এই হরতাল সফল করতে মশাল মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালনেরও ঘোষণা দিয়েছে৷
গত ২৮ অক্টোবর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়৷ এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি৷ রপ্তানি বন্ধের আগের দিনও পেঁয়াজের কেজি ছিলো ৮০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকায়৷ ঘুর্ণিঝড় বুলবুলের পর দুই, একদিন ৩০০ টাকা কেজি দরেও বিক্রি হয়েছে রান্নার এই উপকরণটি৷