আমিনার জন্য ছবি ‘৪৭৫’
৫ জুন ২০১৩২০১২ সালের মার্চ মাসে আমিনা ফিলালিসের আত্মহত্যার খবর শুনে আরো অনেকের মতো কষ্ট পেয়েছিলেন পরিচালক নাদির বুমুশ৷ ১৬ বছর বয়সি আমিনা আত্মহত্যা করেছিল, কেননা সে বিচারকের রায় মানতে পারেনি৷ বিচারক আমিনাকে তার ধর্ষককে বিয়ে করতে বলেছিলেন৷ মরক্কোর আইনের ‘৪৭৫' ধারা অনুযায়ী শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে ধর্ষকরা চাইলে ধর্ষিতাকে বিয়ে করেতে পারে৷ নাদির আগে এই আইনের কথা জানতেনও না৷
আমিনার আত্মহত্যা আর গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রচারের পর নাদিরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর বেগ পেতে হয়নি৷ ২২ বছর বয়সি এই মানবাধিকার কর্মী এবং তথ্যচিত্র নির্মাতা সিদ্ধান্ত নেন আমিনার পুরো ঘটনাটি ফুটিয়ে তুলবেন রূপালি পর্দায়৷ ‘৪৭৫: বিয়ে যখন শাস্তি' বিষয়ক তথ্যচিত্রটি নাদির তৈরি করেছেন ইন্টারনেট থেকে অর্থ সংগ্রহ করে৷ ক্রাউড সোর্সিং পদ্ধতিতে বহু ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছবিটি তৈরির খরচ জুগিয়েছেন৷ আর সেই অর্থ দিয়েই তৈরি হয়েছে যৌন নিগ্রহ ও ‘৪৭৫' ধারার বিরুদ্ধে নির্মিত এই ছবিটি৷
প্রতিবাদের প্রতীক
আমিনাকে নিয়ে তৈরি এই ছবিটি মরক্কোতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে৷ ছবিটিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় একটি ফেসবুক পাতা এবং ওয়েবসাইট৷ ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মেও ঘৃণ্য এই ‘৪৭৫' ধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন হাজারো মানুষ৷ ডয়চে ভেলের জুরিমণ্ডলী যথার্থই বলেছেন, ‘‘ইন্টারনেট ব্যবহার করে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণের এক চমৎকার উদাহরণ ৪৭৫৷''
নাদিরসহ ১২ সদস্যের একটি শক্তিশালী টিম পুরো বিষয়টি তদন্ত করেন৷ ছবিটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন এই টিমের সদস্য হুদা লামকাদাম৷ আমিনার বিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘পরিবারের সম্মতিতে বিচারক আইন অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন করেন৷'' এভাবেই পরিবারটি সম্মান রক্ষা করতে চেয়েছিল৷ কিন্তু এক্ষেত্রে আমিনার সম্মতি নেওয়া হয়নি৷ এই বিয়ের এক বছর পর আমিনা ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে৷
আমিনার এই আত্মহত্যা গোটা মরক্কোয় প্রতিবাদের ঝড় তোলে৷ নারী অধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো আইনের ‘৪৭৫' ধারা বাতিলের দাবি তোলে৷ তবে হুদা লামকাদাম মনে করেন, শুধু আইন বাতিলই এই সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট পদক্ষেপ নয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা সাংস্কৃতিক সমস্যা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরকম অনেক বিয়ে হয়েছে, হচ্ছে এবং সেগুলো বিচারকের নির্দেশনা ছাড়াই৷'' নাদির বুমুশও মনে করেন, শুধু আইন নয়, মানুষের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে৷
অন্যান্য হতভাগারা
ছবির শ্যুটিং করতে আমিনার গ্রামে গিয়েছিলেন নাদির এবং তাঁর দল৷ সেখানে তাঁরা নারী নির্যাতনের আরো কিছু উদাহরণ খুঁজে পান৷ আমিনার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী শুয়া ক্যামেরার সামনেই জানান যে, তাঁর স্বামী তাঁকে পেটান এবং যৌন নির্যাতন করেন৷ হুদা লামকাদাম এ বিষয়ে বলেন, ‘‘সেই গ্রামের প্রত্যেকে এই নির্যাতনের কথা জানেন, কিন্তু কেউই এই বিষয়ে কিছু বলেন না বা তাঁকে সহায়তায় এগিয়ে আসেন না৷''
হুদার কথায়, ‘‘মরক্কোতে বিয়ের পর ধর্ষণ কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়৷ এমনকি বিষয়টির উল্লেখই নেই আইনে৷ তাই আমরা আমাদের ছবিতে এ ধরনের ঘটনা যে প্রতিনিয়ত ঘটছে, সেটা দেখাতে চেয়েছি৷''
উল্লেখ্য, আমিনাকে নিয়ে তৈরি এই ছবিটি ২০১৩ সালের শুরুতে মুক্তির পর থেকে ইন্টারনেটে দেখা যাচ্ছে৷ পাশাপাশি মানুষের অনুরোধের ভিত্তিতে ছবিটি আলাদাভাবে প্রদর্শনও করা হয়৷ মরক্কোর মানুষের মনে যে দাগ আমিনা এঁকে গেছেন, সেটা দীর্ঘদিন থেকে যাবে৷ ৪৭৫ টিমের সদস্যরাও চান, অল্পবয়সি মেয়েদের কাছে যেন এরকম আত্মহত্যা একমাত্র পথ না হয়, তাদের সামনে যেন আরো অনেক পথ খোলা থাকে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ পায়৷ সামাজিক আন্দোলনটা যে সেই উদ্দেশ্যেই চালাতে হবে!