দ্রব্যমূল্যের চাপে কাঁটছাট হচ্ছে খাদ্য তালিকা
৪ জুন ২০২২দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছেন মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ৷ খাদ্য তালিকা থেকে তারা বাদ দিচ্ছেন মাছ-মাংস৷
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম যা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে বাংলাদেশের বাজারে৷ সম্প্রতি কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় এসেছেন৷ তাদের নিয়ন্ত্রণ এতটাই যে, তারা চাইলে পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিয়ে বাজারে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেন৷ এখন বাজার যারা মনিটরিং করছেন তাদের কাছে হয়ত পর্যাপ্ত তথ্য থাকছে না৷ এখানে মনিটরিংটা আরও জোরদার হওয়া দরকার৷''
শেওড়াপাড়া বাজারে মাছ বিক্রি করেন মোসলেম উদ্দিন৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘‘তেলাপিয়া বা পাঙ্গাস মাছের দামও কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়েছে৷ এক কেজি ওজনের রুই আগে ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ পাবদা, টেংড়া মাছের দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে৷ এখন এক কেজি ওজনের একটা ইলিশ এক হাজার ৬০০ টাকার কমে পাওয়া যায় না৷ ফলে সব মাছের দামই গড়ে অন্তত ৫০ টাকা বেড়েছে৷ দাম বৃদ্ধির এই চিত্র গত ১৫ দিনের৷''
একই বাজারে মাংস ব্যবসায়ী আমীর হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গরুর মাংসের দাম গত কয়েকদিনে খুব একটা বাড়েনি৷ এখন ৬৮০-৬৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে৷ খাসির মাংস বিক্রি করছি ৯৫০ টাকা কেজি দরে৷ কিন্তু মাংসের দাম এত বেড়েছে যে আগে যিনি ৪ কেজি কিনতেন, এখন তিনি ২ কেজিও নিচ্ছেন না৷ এক বছর আগেও করোনার মধ্যে প্রতিদিন অন্তত ৫০ কেজি মাংস বিক্রি করেছি৷ আর এখন ২০-২৫ কেজিও বিক্রি করতে পারি না৷'' মানুষের কেনার সামর্থ্য কমে গেছে বলে মনে করেন আমীর হোসেন৷
শেওড়াপাড়া বাজারে শনিবার বাজার করতে এসেছেন গৃহবধূ তাহমিনা আক্তার৷ তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে এই নারী জানালেন, ‘‘বাজারের হিসাব এখন আর মিলছে না৷ আমাদের ৫ জনের সংসার৷ স্বামী-স্ত্রী, দুই সন্তান আর শ্বাশুড়ি৷ খাওয়া বাবদ প্রতি মাসে আমরা সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা খরচ করতে পারি৷ পাঙ্গাস মাছ আমরা আগে কখনও খাইনি৷ কেউ পছন্দও করে না৷ শুধু খরচ বাঁচাতে গত তিন মাসে বহুবার পাঙ্গাস মাছ খেয়েছি৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেলাপিয়াও৷ বাচ্চারা পছন্দ করে না, কিন্তু কি করা? গত এক মাসে একবারও মাংস কিনিনি৷ কারণ মাংস কিনতে গেলে অন্যান্য জিনিস কেনা কঠিন৷ সত্যি বলতে কি, মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামলাতে আমরা খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি৷ বাজারে চাল, আটা, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে আমরা মাছ-মাংসে কাঁটছাট করছি৷''
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বাজারের ৩২ ধরনের খাদ্যপণ্যের দামের ওঠা-নামার হিসাব রাখে৷ সংস্থাটির গত এক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ সময়ের ব্যবধানে বাজারে ৩২ খাদ্যপণ্যের মধ্যে বেড়েছে ১৯টির দাম৷ কমেছে শুধু একটি পণ্যের দাম৷ স্থিতিশীল রয়েছে ১২টির৷
টিসিবি বলছে, এক মাসের ব্যবধানে বাজারে চাল, আটা, ময়দা, সয়াবিন, পাম অয়েল, মসুর ডাল, ছোলা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, হলুদ, আদা, জিরা, তেজপাতা, গুড়া দুধ, চিনি ও ডিমের দাম বেড়েছে৷ বাজারে শুধুমাত্র কমেছে ব্রয়লার মুরগির দাম, যা গত মাসের থেকে বর্তমানে কেজিতে ৫ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে৷ অন্যদিকে টিসিবির তথ্যে বাজারে একমাসের ব্যবধানে মুগডাল, অ্যাংকার ডাল, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনিয়া, রুই মাছ, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস, খাসির মাংস, খেজুর ও লবণের দাম স্থিতিশীল রয়েছে৷
ভোগ্যপণ্য নিয়ে কাজ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)৷ প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিভিন্ন যৌক্তিক কারণে দেশে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে৷ তবে যৌক্তিকভাবে যা বেড়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা৷ এখন সব ইস্যুকে সামনে রেখে বাড়তি মুনাফার সুযোগ খোঁজেন তারা৷ ব্যবসায়ীদের নানান অজুহাত, যার শেষ নেই৷ কারণে-অকারণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের নাজেহাল করা হচ্ছে৷ ব্যবসায়ীদের এ কারসাজি ঠেকাতে দেশে বেশি কিছু বিদ্যমান আইনও আছে৷ তবে সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নেই৷ সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে, তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে৷ ''
প্রতি বছরই সংগঠনটি বাজার নিয়ে তাদের গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে৷ এ বছর এখনও তাদের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি৷ ২০২১ সালের রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে জনাব রহমান বলেন, ‘‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, গত বছরই জীবন-যাত্রার ব্যয় ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে৷ এ বছরের রিপোর্ট আসলে বর্তমান চিত্রটা বলা যাবে৷ তবে এবার যে আরও বেড়েছে তাতে তো কোন সন্দেহ নেই৷ সেই অনুযায়ী, মানুষের আয় বাড়ছে না৷''
এদিকে, শুধু খাদ্যপণ্য নয়, বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য্য অন্যান্য পণ্যের দামও৷ সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল, সেভিং ফোম, টালকম পাউডার, রেজারসহ বিভিন্ন পণ্যের দামও বেড়েছে৷ ব্যয় সামলাতে না পেরে অনেকেই নিত্যব্যবহার্য্য পণ্যের তালিকাও কাটছাঁট করছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন৷ এছাড়া আটা-ময়দার দাম বাড়ায় রুটি, কেক, বিস্কুটের মতো বেকারি পণ্যের দামও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আগে চায়ের দোকানে যে রুটি (বনরুটি) ও পিস কেক ৮ টাকা করে বিক্রি হতো, তা এখন ১০ টাকা৷ আবার ৩০ টাকা দামের ফ্যামেলি রুটি এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকায়৷