ধর্মের দোহাই দিয়ে বাল্যবিবাহ চলবে না
২৪ আগস্ট ২০২১আইনে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে৷ তবে ধর্মের বিধানে মেয়েদের বয়সের বিষয়ে কিছু বলা নেই৷ শুধুমাত্র ছেলে বা মেয়ে সাবালক বা সাবালিকা হলেই বিয়ে দেওয়া যাবে৷ তবে ধর্মে ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিতে হবে এমন কিছু বলা নেই৷ তাই আইন মেনেই বিয়ের কথা বলছেন ধর্মীয় বিশ্লেষকরা৷
গত রোববার কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে বাল্য বিয়েতে উদ্বুদ্ধ করার অভিযোগে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ মিঠামইন থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ির পাশের রাস্তা থেকে এই ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ পরদিন তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলে পাঠানো হয়েছে৷ তারা লিফলেটে বলছে, বিয়ে সংক্রান্ত বর্তমান আইন ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধ৷ কারণ ধর্মে কোথাও মেয়েদের বয়সের কথা উল্লেখ করা নেই৷ এটা নিয়েই তারা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছিল৷ ফলে তাদের গ্রেফতারের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে৷ দুই একদিনের মধ্যেই তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে৷”
আসলেই কী আইন ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধ? জানতে চাইলে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ধর্মে বলা আছে, ছেলে-মেয়েদের সাবালোক বা সাবালিকা হতে হবে৷ কিন্তু সেটা ১৮ বছরের আগে হলেই যে তখনই বিয়ে দিতে হবে, সেটা কিন্তু ধর্মে বলা নেই৷ ধর্ম বলছে, সাবালিকা হলে বিয়ে দেওয়া যাবে৷ কিন্তু কখন দিতে হবে, সেটা সরকার আইন করে বলেছে৷ এক্ষেত্রে আইন মান্য করাই শ্রেয়৷ কেউ যদি এটার ভুল ব্যাখা করেন তাহলে তো হবে না৷ আমি মনে করি, ধর্মীয় বিধান বাল্যবিবাহ বন্ধে কোন বাধা হতে পারে না৷ দেশের জনগণকে সরকারের আইন মানতে হবে৷”
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে আছেন, নিকলীর মো. আনিছুর রহমান (৪৩), মো. মুজিবুর রহমান (৫০), আজহারুল ইসলাম (২৩), মো. ইসলাম উদ্দিন (৪১), মো. রইছ উদ্দিন (৬০), মো. হারুন অর রশিদ (৩৫), মো. আব্দুর রশিদ (৪০), মো. সাইদুর রহমান (৫২), আব্দুস সাত্তার (৫২), মো. আব্দুল হাসিম (৫২), মো. আশরাফ আলী (৬১), মো. মজিবুর রহমান (৫২); কটিয়াদীর মিজানুর রহমান খান (৫৫); অষ্টগ্রামের মহিউদ্দিন (৩২); কিশোরগঞ্জ সদরের ওমর ফারুক (২৬) ও জামাল উদ্দিন (৪০) এবং নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার ইমরান হোসাইন খান (২৯)৷
করোনায় কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে
বাল্যবিয়ে বেড়েছে উল্লেখ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমরাই পারি এর নির্বাহী পরিচালক জিনাত আরা হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "করোনার মধ্যে কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে৷ কারণ আগেও বাল্যবিয়ে ছিল, এখনও হচ্ছে৷ এখন হয়ত বেড়েছে৷ আগে বাল্যবিয়ে হলেও রেজিষ্ট্রেশন হতো৷ নতুন আইন হওয়ার পর এখন মেয়ের বয়স ১৮ বছরের কম হলে সেটার রেজিষ্ট্রেশন হচ্ছে না৷ বিয়ে তো দুই ধরনের, একটা আইন অনুযায়ী, আরেকটা শরীয়া অনুসারে৷ আমাদের দেশে শরীয়া অনুসারে অল্প বয়সে বিয়ে হতে কোন বাধা নেই৷ আইনেও সেটা বলা হয়নি৷ ফলে অনেকের অগোচরেই শরীয়া অনুসারে বিয়ে হচ্ছে৷ সেখানে রেজিষ্ট্রেশন না হওয়ায় কিশোরীরা ঝুঁকিতে পড়ছে৷ এই বিয়েটা যদি কোন কারণে না টেকে তাহলে তো মেয়ের কোন অধিকারই থাকছে না৷ কোন কিছু দাবি করতে গেলেও তো রেজিষ্ট্রেশনের কাগজটা দরকার৷ তাদের তো সেটা থাকছে না৷ এটা আমাদের জন্য একটা ভয়ের কারণ৷ রেজিষ্ট্রেশনটা অবশ্যই থাকতে হবে৷”
যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময় বাল্যবিয়ে বন্ধে চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ এখন যে সমস্যাটা হচ্ছে, আগে স্কুল-কলেজ খোলা থাকার সময়ে সহপাঠী বা অন্য কোন মাধ্যমে বাল্যবিয়ের খবরটা আমরা জানতে পারতাম৷ এখন অনেক খবরই আমরা জানতে পারি না৷ গোপনে হয়ত সেটা হচ্ছে৷ ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার বা গ্রাম পর্যায়ে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মাধ্যমে খবরটা পেলেই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে বিয়ে বন্ধের উদ্যোগ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়৷”
করোনায় বাল্য বিয়ে কতটা বেড়েছে?
করোনাকালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অন্যান্য সময়ের তুলনায় দেশে বাল্যবিবাহ ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা ২৫ বছরে সর্বোচ্চ৷ দেশের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের গবেষণায় এই তথ্য উঠে আসে৷ এই গবেষণায় ব্র্যাকের সঙ্গে কাজ করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প সমন্বয়ক অর্পিতা দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, "গত বছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাস আমরা ২১ জেলায় ২১ হাজার মানুষকে নিয়ে গবেষণা করেছি৷ সেখানে ১৩ হাজার ৮৮৬ টি বাল্যবিবাহ হয়েছে৷ যার অর্ধেক ক্ষেত্রেই কন্যার বয়স ছিল ১০-১৫ বছর৷ যদিও আগে কোন গবেষণা না থাকায় আসলেই কতটা বাল্যবিয়ে বেড়েছে সেটা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি৷
ব্র্যকের ওই গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে৷ বাল্যবিবাহে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ৷ ওই গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, করোনাকালে অভিভাবকের কাজকর্ম না থাকায় ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার কারণে ৮৫ শতাংশ, সন্তানের স্কুল খোলার অনিশ্চয়তায় ৭১ শতাংশ এবং করোনা মহামারী দীর্ঘ স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় অনিরাপত্তা বোধ এবং বিদেশ থেকে আসা ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ বেড়েছে বাল্যবিবাহ৷
গত বছরের অক্টোবরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উত্থাপিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালে প্রথম তিন মাস অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সারাদেশে ২৩১টি বাল্যবিয়ে হয়েছে এবং ২৬৬টি বাল্যবিয়ে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে৷ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাল্যবিয়ে হয়েছে কুড়িগ্রাম, নাটোর, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলায়৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, গেল মাসে ৪৬২টি কন্যা শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয় এর মধ্যে প্রশাসন ও সচেতন মানুষের উদ্যেগে ২০৭টি বিয়ে বন্ধ করা সম্ভব হয়৷
বেশী সংখ্যক বাল্যবিয়ে হওয়া জেলাগুলোর একটি যশোর৷ সেখানকার জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান অবশ্য এই তথ্য জানেন না৷ তিনি বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু যশোর যে এর মধ্যে একটা সেটা কেউ আমাকে বলেনি৷ অবশ্যই আমরা আরো কঠোরভাবে বাল্যবিয়ে বন্ধে আন্তরিকভাবে সামনের দিনে কাজ করে যাব৷”