নতুন বছরেও তাদের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ
১ জানুয়ারি ২০২১বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামকরোনাকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকার বিষয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া চিকিৎসক, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীকে আমি স্যালুট জানাই৷ শুরুতে ডাক্তারদের কাছে আমরা পিপিই, মাস্ক পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনি, তারপরও তারা হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে যাননি৷ যতটুকু পেরেছেন চিকিৎসা দিয়েছেন৷ আমি তো মনে করি, সঠিকভাবে তাদের কাছে সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছানো গেলে স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যু আরো অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হতো৷''
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বিএমএ'র হিসাব অনুযায়ী ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে মারা গেছেন ১২৫ জন চিকিৎসক৷ এর মধ্যে দুই জন ডেন্টাল সার্জন এবং সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসক ১৩ জন৷ এছাড়া নার্স ও টেকনিশিয়ান মারা গেছেন ১৮ জন৷ সরকারি হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা কিছুটা কম৷ আর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ১৫৭ জন৷ এর মধ্যে চিকিৎসক ২ হাজার ৮৯০ জন, নার্স ১ হাজার ৯৮২ জন এবং টেকনিশিয়ান ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ৩ হাজার ২৮৫ জন৷
সরকারপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সেনাল মনে করেন, কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া চিকিৎসকদের সামনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘শুধুমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের প্রস্তুতির অভাবের কারণে চিকিৎসকদের ঠিকমতো ট্রেনিং দেওয়া যায়নি৷ শুরুতে তাদের পিপিই, মাস্ক, গ্লাভসসহ সুরক্ষা সামগ্রী পৌঁছানো যায়নি৷ যা-ও গেছে তা-ও ছিল নিম্নমানের৷ ফলে প্রস্তুতির অভাবের কারণে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে গেছে৷ অথচ শুরুতে আমরা প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছি, প্রস্তুতির জন্য৷‘‘
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম মনে করেন, প্রস্তুতির কিছু অভাব ছিল সত্যি, কিন্তু সেটা গাফিলতি নয়, বুঝতে না পারার কারণে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ‘‘এই মহামারি সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা৷ বিশ্বও প্রস্তুতি নিতে পারেনি, আমরাও পারিনি৷ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুতিও বেড়েছে৷ এখন কিন্তু একই হাসপাতালে কোভিড-নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে৷ ডাক্তার-নার্সরা দক্ষ হয়ে উঠেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রশংসা করেছেন৷ এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিভাগ ভালো করেছে বলেই তো ব্লুমবার্গের করোনা ‘নিরাপদ' দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ২০ দেশের মধ্যে স্থান পেয়েছে৷ আমেরিকা, জার্মানির মতো বড় দেশ তা পারেনি৷ এই স্বীকৃতির কারণে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার সুযোগ নেই৷ তবে এটা তো একটা স্বীকৃতি তা মানতে হবে৷''
বিএমএ'র সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘স্বাস্থ্যকর্মীদের তো স্যালুট জানাতেই হবে৷ তবে আমি ঢালাওভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে দায়ী করবো না৷ তাদের কিছু ঘাটতি ছিল৷ আসলে পরিস্থিতিটা তো একেবারেই নতুন৷ কেউই বুঝে উঠতে পারেনি কী করা উচিত৷ ডাক্তারদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতিও বদলে গেছে৷ মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতা ছিল৷ তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে বিষয়টি দেখভাল করে সমাধান দিয়েছেন৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সরিয়ে নতুন একজনকে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব দিয়েছেন৷ ফলে আস্তে আস্তে সমন্বয়হীনতাও কেটে গেছে৷ শুরু থেকে মনোযোগ দিলে হয়তো আরো ভালো করা যেতো৷''
বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়৷ ১৮ মার্চ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম কেউ মারা যান৷ সরকারও ২৬ মার্চের পর থেকে সবকিছু বন্ধ করে দেয়৷ এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সিনিয়র স্টাফ নার্স দিলরুবা আক্তারকে করোনার জন্য নির্ধারিত কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে বদলি করা হয়৷ ১ এপ্রিল থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত তিনি ওই হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ ডয়চে ভেলেকে নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে দিলরুবা বলেন, ‘‘শুধু তো হাসপাতাল নয়, বাইরেও সংকটে পড়তে হয়েছে৷ হাসপাতালে ডিউটি শুরুর আগে মাকে আনতে নিজের বাড়ি মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম৷ কারণ, ছোট একটি ছেলে আছে, তাকে দেখভাল করার জন্য৷ রাস্তায় নানা বাধা পেরিয়ে মানিকগঞ্জ পৌঁছালেও আমাকে গ্রামে ঢুকতে দেয়নি৷ মা হাইওয়েতে এসে আমার গাড়িতে উঠেছে৷ হাসপাতালে ডিউটি শুরুর পর আইসিইউতে আমি দায়িত্ব পালন করেছি৷ দুইটা পিপিই, চারটা হ্যান্ডগ্লাভসসহ সুরক্ষা সামগ্রী পরে মনে হতো জীবন বের হয়ে যাচ্ছে৷ তাছাড়া প্রতিদিনই কারো না কারো লাশ বের করতে হতো৷ প্রথমদিকে ওখানে যাওয়ার পর থাকতে দিলেও খাবার দিতে পারেনি৷ কারণ, যারা রান্না করবে তারা পালিয়ে গেছে৷ দুই-তিন দিন এভাবেই কেটে গেছে৷ পরিবারের চাপ ছিল চাকরি ছাড়ার, কিন্তু আমি তো পড়েছি নার্সিংয়ে৷ ফলে যে কোনো পরিস্থিতিতে রোগীর সেবা করাই আমার কাজ৷ সেই কাজটি যত্ন করে করার চেষ্টা করেছি৷''
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের বাবা মমিনুল হকও৷ নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘‘আমার চোখের সামনে আমার বাবা মারা গেছেন করোনায় আক্রান্ত হয়ে৷ আমি নিজে দেখেছি, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা কতটা চেষ্টা করেছেন৷ কিন্তু তখন আমরা জানতামই না, অক্সিজেনের এত দরকার৷ কিছু অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু হাইফ্লো অক্সিজেন দিলে যে কাজ হয় সেটা তো তখন আমরা বুঝতে পারিনি৷ এখন বুঝেছি৷ ফলে করোনা অনেক প্রাণ নিয়ে গেলেও অনেক কিছু আমরা শিখেছিও৷ সারা দেশে ১৭৮টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেনের ব্যবস্থা হয়েছে৷ চিকিৎসা ব্যবস্থার দুর্বলতার জায়গায়গুলোও আমরা দেখেছি৷ এখন সেগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে৷''